নিজস্ব প্রতিবেদক,
অনলাইনে আন্তর্জাতিক বেটিং সাইটগুলোতে বাংলাদেশি জুয়াড়িদের অংশগ্রহণ বেড়েই চলেছে।
এর ফলে অনেক বাজিকর তো সর্বস্বান্ত হচ্ছেই, একইসঙ্গে দেশের টাকার একটি অংশও চলে যাচ্ছে বিদেশে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, তাদের অভিযানে বেশ কয়েকজন অনলাইন জুয়াড়ি ধরা পড়েছে। তবে রাঘব
বোয়ালরা ঠিকই ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছে।
নগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার অতিরিক্ত উপ কমিশনার (এডিসি) শাহ মোহাম্মদ আব্দুর রউফ আজাদীকে
বলেন, নগরীতে অনলাইন জুয়ার সাথে একাধিক চক্র জড়িত রয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি। তবে
একেকটি চক্রের ক্যাটাগরি একেক রকমের। পুলিশও সেসব মাথায় নিয়ে ধাপে ধাপে তাদের শনাক্ত করার
পাশাপাশি গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি বলেন, অনলাইনে জুয়া খেলা ডিজিটাল আইনের অপরাধের
মধ্যে পড়ে। পাশাপাশি যেহেতু এখানে ডলার লেনদেন হয়; টাকা বিদেশে পাচার হয়, সেক্ষেত্রে এ অপরাধ
মানি লন্ডারিং আইনের আওতাভুক্ত। গত ১ ডিসেম্বর সিএমপির কোতোয়ালী থানা পুলিশ শাহাদাত
হোসেন রিয়াদ নামে জাহাজের এক নাবিককে গ্রেপ্তার করে যার নেশা হলো অনলাইনে জুয়া খেলা। এ
জুয়ার টাকা যোগাতে তিনি একটি শিপিং প্রতিষ্ঠানের নাম, সীল, ই-মেইল এড্রেসসহ যাবতীয়
ঠিকানা ব্যবহার করে প্রতারণার ফাঁদ পাতেন এবং মাত্র ২০ দিনে ২১ জন থেকে হাতিয়ে নেন ১৯ লাখ
টাকা।
পুলিশ জানায়, ২০১৯ সালেও একবার হালিশহর থানায় তিনি ৮ থেকে ১০ জন যুবকের কাছ থেকে একই
কায়দায় বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করে হালিশহর থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। সেবার
৩১ দিন জেলও খাটতে হয় তাকে। কিন্তু নেশা তার যায় নি। নগরীর রেল স্টেশন এলাকায় মুজিব প্রকাশ মজিদ
নামে এক ব্যক্তি অনলাইন জুয়ার আসর বসিয়েছেন একটি ভাতঘরে। প্রথম দিকে তাঁর আসর বসতো
নতুন স্টেশনস্থ ৭ নং বাস পার্কিংয়ে। কিন্তু জানা যায়, সেখানে কোতোয়ালী থানা পুলিশের একটি
স্থায়ী বুথ গড়ে তোলায় এবং থানার মোবাইল পার্টির গাড়ি সেখানে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করায় নিরুপায়
হয়ে তিনি পুরাতন রেল স্টেশনে চলে আসেন গত মার্চ মাসে। সেখানে ‘ক্যান্টিন’ নামে পরিচিত
একটি ভাতের হোটেলে সহযোগীদের নিয়ে তিনি আসর বসিয়েছেন। বিভিন্ন দোকানের কর্মচারী ও
শ্রমজীবী লোকজন তার অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে বাজি ধরেন। মাঝখানে কমিশন নেন মজিব ওরফে মজিদ।
এভাবে অনলাইনে বাজি ধরে নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন তারা। নিঃস্ব হয়ে বিভিন্ন অপরাধেও যুক্ত হচ্ছেন। গত ১০
ডিসেম্বর রাতে কোতোয়ালী থানা পুলিশ সেখানে অভিযান চালিয়েও তাকে ধরতে ব্যর্থ হয়। মুজিবের
ওখানে নিয়মিত বাজি ধরা রাকিব ও রফিক নামে দুজন আজাদীকে জানান, একটা সময় বাজির টাকা
লেনদেন নিয়ে মারামারি, লোক জানাজানিসহ নানা ঝামেলা শুরু হয়। ফলে নিরাপদ বাজি খেলার জন্য
বাজিকররা আন্তর্জাতিক বেটিং সাইটগুলোর দিকে ঝুঁকতে শুরু করেন। এখন অনেকেই অনলাইনে বেটিং
করেন।
কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন বলেন, ‘অনলাইনে জুয়া মহামারী
আকার ধারণ করেছে। রেল স্টেশন কেন্দ্রিক চক্রটিও আমাদের নজরদারিতে আছে। আমরা ইতোপূর্বে
রিয়াজউদ্দিন বাজার পাখি গলিতে মো. ইদ্রিসের ভাতঘরে অভিযান চালিয়েছিলাম। সেখানে অনলাইন
জুয়ার আখড়া গড়ে তুলেছিলেন ইদ্রিস। জুয়ার সাইটগুলোতে তার নামে অ্যাকাউন্ট রয়েছে। আমরা
অভিযান চালিয়ে ইদ্রিসের জুয়ার আখড়া থেকে তাকেসহ ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে চালান করে
দেই। শুধু তাই নয় কোতোয়ালী থানা পুলিশ ইতোপূর্বে আনসার ক্লাবের সামনে থেকে অনলাইন জুয়ার
তিন কারবারীকে গ্রেপ্তার করে।
অনলাইনে বেটিং করেন এমন বাজিকরের সঙ্গে আলাপ করে ও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনলাইনে বেশকিছু
বেটিং সাইট আছে, যারা ক্রিকেট, ফুটবলসহ অসংখ্য খেলায় বাজি ধরার ব্যবস্থা করে দেয়। এগুলো
বেশিরভাগই ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া বা যেসব দেশে জুয়া বৈধ সেসব দেশভিত্তিক। সেসব সাইটে
অ্যাকাউন্ট খুলতে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। ডলারও জমা দিতে হয়। এর জন্য প্রয়োজন হয় পাসপোর্টের কপি,
ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। বাংলাদেশিদের এই দেশে থেকে ওইসব সাইটে অ্যাকাউন্ট
খোলা প্রায় অসম্ভব। এজন্য পরিচিত বাংলাদেশি অথচ বিদেশে থাকেন তাদের নামে বাজিকররা
অ্যাকাউন্ট খোলেন। আর সেই অ্যাকাউন্ট চালানো হয় বাংলাদেশ থেকে। বেটিং অ্যাকাউন্টের টাকা
লেনদেন হয় বিদেশে থাকা ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে। কিন্তু বাংলাদেশে থাকা অ্যাকাউন্ট চালনাকারীর সঙ্গে
লেনদেন হয় অন্য উপায়ে। হয় তিনি মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাঠান, অথবা বিদেশে থাকা
ব্যক্তির বাংলাদেশি প্রতিনিধি টাকা আদান প্রদান করেন।
আরও জানা গেছে, যাদের বিদেশে কোনো পরিচিতজন নেই তাদের জন্যও রয়েছে অন্য ব্যবস্থা। মাসিক
ভাড়ায়ও পাওয়া যায় বেটিং অ্যাকাউন্ট। বাংলাদেশে এখন ভাড়ায় বেশি চলছে বেটিং অ্যাকাউন্ট। বেটিং
সাইটগুলোয় যেকোনো খেলা শুরুর আগে বাজির দর নির্ধারণ করে দেয়া হয়। কোন দলের পক্ষে বাজি ধরে
জিতলে কত টাকা দেয়া হবে এবং হারলে কত টাকা দিতে হবে সেটা উল্লেখ করা থাকে। শুধু তাই নয়,
বাজি ধরার জন্যও রয়েছে পরামর্শ সাইট ও ফেসবুক পেইজ। এসব সাইট বা পেইজে যে কোনো
টুর্নামেন্টের শুরুতে ফ্রিতে পরামর্শ দেয়া হয় এবং খেলা সম্পর্কিত নানা তথ্য দেয়া হয়। পরে টাকার
বিনিময়ে পরামর্শ দেয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যারা বাজি ধরতে চান প্রথমে তারা মোবাইলে চক্রের কারো সঙ্গে
যোগাযোগ করেন। পরে বাজির লেনদেন হয় পরদিন, বিকাশ বা নগদে। তবে অবশ্যই বাজিকরকে বিশ্বস্ত হতে
হয়। মানে টাকা যেন ঠিকভাবে লেনদেন হয়। জিতলে যেমন টাকা পাওয়া যায় তেমনি হারলে যেন টাকা
দেয়া হয় সেটা নিশ্চিত হতে হয়।
ঢাকা/ এসআই/এমএম