নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও ডলারের বিনিময় হার নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। কারণ অর্থপাচার বন্ধের কারণে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স বাড়ছে। এখন পর্যন্ত রেমিট্যান্সে ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আছে। চলতি অর্থবছরে রেমিট্যান্স ৩০ বিলিয়ন ছাড়াবে।
তিনি বলেন, চলতি বছরের মধ্যে পাচারকারীদের সম্পদ জব্দ করা সম্ভব হবে। মামলা করে অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া শেষ করতে অন্তত ৫ বছর লাগবে। পরে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক এই উদ্যোগ যেন থেমে না যায়। রাজনৈতিক কারণে যেন পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার প্রক্রিয়া থেমে না যায়।
বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং ব্যাংকিং খাতের সংস্কার’ শিরোনামের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. আহসান এইচ মনসুর এসব কথা বলেন। পল্টন ইআরএফ মিলনায়তনে এ প্রোগ্রাম অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো প্রফেসর ড. মুস্তাফিজুর রহমান ও পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আলী। ইআরএফের সভাপতি দৌলত আকতার মালার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ইআরএফের সহ-সাধারণ সম্পাদক মানিক মুনতাশির।
আলোচনা সভায় আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশের অর্থনীতি সবসময় চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে গেছে। তবে বর্তমানের মতো সব দিক থেকে একবারে এতো চ্যালেঞ্জ কখনো আসেনি। শ্রীলঙ্কায় শুধু বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের (বিওপি) সংকট তৈরি হয়েছিল। আমাদের এখানে বিওপি, মূল্যস্ফীতি, রাজস্ব, দুর্বৃত্তায়নের কারণে ব্যাপক অর্থপাচার হয়েছে। আশার বিষয় হলো- বৈদেশিক বাণিজ্যের চলতি হিসাব বড় ধরনের নেতিবাচক থেকে ইতিবাচক হয়েছে। আর্থিক হিসাবের ঘাটতি কমেছে। মূল্যস্ফীতি কমেছে। আরও কমবে। ট্রেজারি বিল, বন্ডের সুদহার কমতে শুরু করেছে। সাড়ে ১২ শতাংশে ওঠা সুদহার এখন সাড়ে ৯ শতাংশে নেমেছে। এর মানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি কাজ করতে শুরু করেছে। পুরোপুরি ফল পেতে এক থেকে দেড় বছর সময় লাগবে।
তিনি বলেন, উচ্চ সুদের কারণে বিনিয়োগ আসেনি এটা ঠিক না। দেশের বিনিয়োগ না বৃদ্ধিও প্রধান কারণ ছিল আমানতে কম প্রবৃদ্ধি। মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ আমানত প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এর মানে এক বছরে এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা আমানত বাড়ছিল। এর মধ্যে এক লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা সরকার নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। ব্যয় সংকোচনের মাধ্যমে এখন লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে অর্থমন্ত্রণালয় ৯৯ হাজার কোটি টাকা করেছে। আমরা বলেছি ৯০ হাজার কোটি টাকা নিতে। ফলে আগামীতে বেসরকারি খাত ঋণ পাবে। ব্যাংকগুলোর এমডিরা ঘুমিয়ে থেকে মুনাফা করার দিন শেষ হয়ে আসছে। আবার বেসরকারি খাতে ঋণ দিয়ে আয় করতে হবে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার না কমালেও সুদহার কমবে।
গভর্নর বলেন, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও ডলারের বিনিময় হার নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। অর্থপাচার বন্ধের কারণে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স বাড়ছে। এখন পর্যন্ত রেমিট্যান্সে ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আছে। চলতি অর্থবছরে রেমিট্যান্স ৩০ বিলিয়ন ছাড়াবে। রপ্তানিও বাড়ছে। সব মিলিয়ে সরকার পরিবর্তনের পর রিজার্ভ থেকে এক ডলারও বিক্রি না করে বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয়েছে। অনেকেই ডলারের দর ১২২ টাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তবে আমরা বলেছি, দুবাই থেকে ডলারের দর নির্ধারণ হবে না। আমরা যে দর দেব সেই দরেই আমাদের ব্যাংকগুলো ডলার কেনবে। এখন খোলাবাজারে ১২৩ টাকা ৫০ পয়সায় ডলার পাওয়া যাচ্ছে। ব্যাংকগুলো দিচ্ছে ১২১ টাকা ৫০ পয়সা। এর সঙ্গে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা যোগ হয়ে পাচ্ছে ১২৪ টাকা। এর মানে ব্যাংকে বেশি দর পাচ্ছে। ধীরে-ধীরে ডলারের দর বাজারভিত্তিক করবে। তবে সেটা এখনই নয়।
ড. মনসুর বলেন, পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার বড় চ্যালেঞ্জ। তবে ফেরানো অবশ্যই সম্ভব। মালয়েশিয়া, অ্যাঙ্গোলা, নাইজেরিয়া অনেক দেশ টাকা ফেরত এনেছে। তবে এজন্য ৫ বছর সময় লেগেছে। আমরা কেনো আশা করবো না। অবশ্যই চেষ্টা করবো। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে। এরই মধ্যে অনেকগুলো যৌথ তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। এক দুই বছরে এটা হবে না। পরবর্তী সরকার যেন সঠিক পথে নিয়ে যায়। এটা যদি কন্টিনিউ না থাকে তাহলে সফলতা আসবে না।
তিনি বলেন, ব্যাংক খাতের যে ক্ষত হয়েছে, সেখানে বড় ধরনের নীতি নিতে হবে। ইতোমধ্যে ব্যাংক রেজুলেশন অ্যাক্টের খসড়া করা হয়েছে। দুর্বল ব্যাংক আমানতকারীদের শতভাগ নিরাপদ করে পুনঃমূলধনীকরণ করা হবে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে ইসলামী ব্যাংক। এই ব্যাংক থেকে ৮০ থেকে ৮৭ কোটি টাকা একটি পরিবার নিয়ে গেছে। তার পরও ঘুরে দাঁড়িয়েছে মানুষের আস্থার কারণে। তারা প্রচুর আমানত পাচ্ছে। এরই মধ্যে ঋণ দেওয়া শুরু করেছে।
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী বহুমাত্রিক এত চ্যালেঞ্জ একসঙ্গে দেখা যায়নি। এর কারণ প্রত্যাশার ব্যাপক চাপ আছে। পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে।
বিনিয়োগ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, বিনিয়োগ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ দুটি খাত হলো- ব্যাংক ও রাজস্ব খাত। তবে এনবিআরের কার্যকর সংস্কার না হলে ব্যাংক খাত এগোবে না।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, আমরা এক সময় সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক ছিলাম। এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৫৪ শতাংশ। এখন সেই ব্যাংকটি একটি ভালো ব্যাংকের পরিণত হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে সুশাসন প্রতিষ্ঠার কারণে।
ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য পরিচালক নিয়োগের নীতিমালা আরও সুগঠিত করার সুপারিশ করেন পূবালী ব্যাংকের এমডি। তিনি বলেন, আইটি বেইজড সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলে পলাতক কেউ ই-কেওয়াইসি দিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে না।