যশোদা জীবন দেবনাথের জন্ম ফরিদপুরে। ছেলেবেলা থেকেই জীবনের নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে নিজের অস্তিত্বের জানান দেন তিনি। মাত্র ছয় বছর বয়সেই পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয় তাকে। জীবনের সাথে ঝলসে যাওয়া জীবনের নির্মম অভিজ্ঞতার সাক্ষী তিনি। বর্তমানে তিনি বেঙ্গল ব্যাংকের পরিচালক।এর চেয়েও অধিক পরিচিত টেকনোমিডিয়া লিমিটেড, মানি প্লান্ট লিঙ্ক ও প্রোটেকশন ওয়ান প্রাইভেট লিমিটেডের কারণে। দেশের এটিএম মেশিনের সিংহভাগই সরবরাহ করছে তার প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি তিনি সফলতা-ব্যর্থতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন বর্তমান সময়ের সাথে। তার মুখোমুখি হয়েছিলেন ফয়সাল আহমেদ।
বর্তমান সময়: কেমন আছেন, কেমন চলছে দিনকাল?
ড. যশোদা জীবন দেবনাথ: খুব ভালো আছি। সবকিছু মিলে বেশ ভালো চলছে।
বর্তমান সময়: আপনার ছেলেবেলার গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই।
ড. যশোদা জীবন দেবনাথ: এসএসসি পরীক্ষার আগ মুহূর্তে মুষলধারে অনেক বৃষ্টি হচ্ছে, প্রথম দিন আমাদের বাড়িতে খাবার মতো কিছু ছিল না। এমন অবস্থায় ঘরের পাশে একটি নারকেল গাছ থেকে কয়েকটা নারকেল পেড়েছিলাম আমি। গাছে উঠতে গিয়ে বুকে ক্ষত হয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। বুকে রক্ত আর মাথায় নারকেল নিয়ে তিন কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে সেগুলো বিক্রি করি। ২ কেজি চাল আর একটা ছোট ইলিশ মাছ কিনে নিয়ে আসলাম। মা রান্না করে খাওয়ালো আমাদের। সেদিনের সেই খাবারের মত সুস্বাদু খাবার আর কখনো মনে হয়নি। সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে। আস্তে আস্তে আমি বড় হই। অনেক বন্ধুদের কাছে বলতাম আমাকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দাও। কিন্তু এই পৃথিবীর ইতিহাস হচ্ছে- মানুষের অর্থ না থাকলে শুভাকাঙ্খীরাও পাশে থাকে না। অনেক প্রিয়মুখও দূরে সরে যায়।
বর্তমান সময়: আত্নপ্রকাশলগ্নে কোন প্রতিবন্ধকতার কথা মনে পড়ে?
ড. যশোদা জীবন দেবনাথ: আমার ছোটবেলার গল্প অনেকটা সুখের ছিলোনা। দারিদ্রতার সাথে অনেক সংগ্রামের সাক্ষী আমি। বলতে দ্বিধা নেই এ যুদ্ধ খাবারের সাথেও ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বাবা গুলিবিদ্ধ হয়। ওই অবস্থায় আমাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেযইয়া হয়েছিল। আমরা অনেক কষ্টে ছয়দিন হেঁটে আমাদের ফরিদপুর থেকে সেই রানা ঘাটে চলে যায়। আমরা শরণার্থী শিবিরে দীর্ঘ নয় মাস কাটানোর পরে বাংলাদেশে এসে দেখি আমাদের বাড়িঘর লুটপাট করে নিয়েছে। স্কুল জীবন পর্যন্ত আমরা চরম দারিদ্র্যের সীমানায় থেকে আস্তে আস্তে বড় হই। প্রতিকূলতা ছিল অনেক। সেগুলো অতিক্রম করেছি সততা আর সাহস দিয়ে। কতকিছুই আমাদের চারপাশে ঘটে, তার সবকিছু কি আমরা জানি? কি লাভ বিষাদ বাড়িয়ে!
বর্তমান সময়: আপনার চরিত্রের শক্তিশালী দিক কোনটি বলে মনে করেন?
ড. যশোদা জীবন দেবনাথ: এক কথায় বলতে গেলে আত্নশক্তি। আমি সকালে কাজে বের হই, কিন্তু সন্ধ্যা অবধি কাজ করার পড়েও মনে হয় আমি এখনি কাজে আসছি। ইচ্ছাশক্তি জাগ্রত হলে কেউ আপনাকে থামাতে পারবে না।
বর্তমান সময়: সামনের পরিকল্পনা জানতে চাই?
ড. যশোদা জীবন দেবনাথ: আমি বর্তমানে অনেকগুলো প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছি। যেগুলোতে আমাকে আইসিটি মিনিস্ট্রি সাহায্য করছে। বাংলাদেশে এখন প্রায় ১৪০০০ এটিএম মেশিন আমার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের সব মানুষের কাছে এখনো এই সুবিধাগুলো পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। ডিজিটাল প্রেমেন্ট সিস্টেমটা আমরা ইউনিয়ন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছি। একটা শহরের মানুষ যদি ২৪ ঘন্টা ব্যাংকিং সুবিধা পেতে পারে তাহলে একটি গ্রামের মানুষও সেটা পাবে। আমি এই গ্রামের মানুষের সাথে কানেক্টিং এক্টিভিটিস তৈরি করার জন্য এটিএম কে ইউনিয়ন পর্যায়ে নিতে পরিকল্পনা করে রেখেছি, এমনকি কাজও শুরু করেছি। এ সুবিধা চালু হলে গ্রামের মানুষের ঘরের ভেতর টাকা রাখার প্রবণতা কমে যাবে। তখন এটা ব্যাংকিং চ্যালেন্জে আসবে।
এ জাতীয় আরও সাক্ষাৎকার পড়ুন- যতক্ষণ প্রাণ আছে মানুষের সেবায় কাজ করে যাবো
বর্তমান সময়: আমরা জেনেছি একাধিকবার পুলিশের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এই মানসিকতা কিভাবে আসলো?
ড. যশোদা জীবন দেবনাথ: আমার ক্যারিয়ারের প্রথম ব্যক্তি একজন পুলিশ অফিসার তিনি আমাকে সাহায্য করেছিলেন। আমি রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হই, রাজেন্দ্র কলেজে পড়াশোনা করতাম অনেক স্ট্রাগল করতাম, ওই সময় আমাকে সাহায্য করেছিল কোতোয়ালি থানার ওসি মোস্তফা কবির নাম করে এক ভদ্রলোক। আমাকে প্রচন্ড সাহায্য করত, তার বাসায় বাচ্চাদের পড়াতাম। পরবর্তীতে সে আমাকে ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছে ঢাকাতে এসেও। একদিন বৃষ্টি পড়ছিলো দুইজন সিপাহী লেভেলের পুলিশ আমার বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন এবং তারা আমাদের বাড়িতে অবস্থা নেয়। তারা আমার মাকে বলে, আপনার ছেলে তো অবস্থা সম্পূর্ণ। তাকে বলে আমাদের একটা গাড়ির ব্যাবস্থা করে দেন। তখন মা আমাকে বললো তিনি পুলিশদের কথা দিয়েছেন একটা গাড়ি দেওয়ার জন্য। মা আমাকে বললেন তুমি এটা দাও। তখন আমি মায়ের কথা রক্ষা করার জন্য তাদের গাড়ি দিলাম। তার পর মা বললো এখানে একটা পুলিশ ফাঁড়ি করে দেও। তখন আমি সেখানে জমি দান করে দিলাম।
বর্তমান সময়: তরুনদের জন্য কি পরামর্শ?
ড. যশোদা জীবন দেবনাথ: চাকরি একটা বদ নেশা। কারো যদি সৎ ইচ্ছা থাকে তাহলে সে চাকরির পেছনে ঝুকবে না। ব্যবসা করবে অথবা ফ্রিল্যান্সিং। অনেক কাজ করার সুবিধা আছে। একটা চাকরি করে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা বেতন পায়। অপরদিকে ফ্রিল্যান্সিং করে ১ লক্ষ টাকার উপরে আয় করা সম্ভব। এক্ষেত্রে কিন্তু নিজের স্বাধীনতাও রয়েছে। সুতরাং আমি সবসময় তরুনদের চাকরির পেছনে দৌড়াতে নিষেধ করি।
বর্তমান সময়: আমাদের সময় দেবার জন্য ধন্যবাদ।
ড. যশোদা জীবন দেবনাথ: আপনাকেও ধন্যবাদ। বর্তমান সময়ের জন্য শুভকামনা।