প্রতিবছর ৮০ শতাংশ অর্থ পাচার হচ্ছে আমদানি-রফতানির আড়ালে। বাংলাদেশ থেকে এসব অর্থ যাচ্ছে পৃথিবীর ৩৬ দেশে। সবচেয়ে বেশি যাচ্ছে ১০ দেশে। যার বড় অংশই জমা হচ্ছে সুইস ব্যাংকে। মূলত অর্থ পাচারের ঘটনায় পাঁচ কারণকে চিহ্নিত করেছেন অর্থনীতিবিদরা। এরমধ্যে রয়েছে-বিনিয়োগের পরিবেশের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার শঙ্কা, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর দুর্বল নজরদারি, আইনের শাসনের ঘাটতি এবং বেপরোয়া দুর্নীতি। গত ৫ বছরে অর্থ পাচারের ১০২৪টি প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইউ)। বিদেশী সংস্থার উপাত্তেও মিলেছে ভয়াবহ খবর। তারপরও মামলা হয়েছে হাতে গোনা। সেগুলোও আটকে আছে আইনী জটিলতায়। দুদক বলছে, মামলার ফল না আসা পর্যন্ত পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। এজন্য টাকা পাচার বন্ধে, অর্থ লেনদেনের গতিবিধি ডিজিটাল মাধ্যমে তদারকি করতে নতুন আইন করা হচ্ছে। পাশাপাশি বর্তমান কিছু আইনেও সংশোধন আনা হবে। তবে, টাকা পাচারের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- করার দাবি করেছেন দুদকের আইনজীবীরা।
কানাডার সরকারী সংস্থা ফিনট্রাকের তথ্য করোনা মহামারীর মধ্যে গত এক বছরে ১ হাজার ৫৮২টি টাকা পাচার ঘটনা ঘটেছে। মূলত করছাড়, প্রশ্নবিহীন বিনিয়োগের অবাধ সুযোগের প্রলোভন দিয়ে উন্নয়নশীল দেশের টাকা নিজেদের অর্থনীতিতে নিতে আগ্রহী উন্নত দেশগুলো। অর্থ পাচারের খোঁজ খবর রাখে, এমন সব বৈশ্বিক সংস্থার তথ্য উপাত্ত বলছে, বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার হয় বিশ্বের ৩৬টি দেশে। তবে সবচেয়ে বেশি হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে ১০ দেশের অর্থনীতি। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে সিঙ্গাপুর, কানাডা, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, হংকং এবং থাইল্যান্ড। আমদানিতে মূল্য বেশি দেখানো বা ওভার ইনভয়েসিং, রফতানিতে কম মূল্য কম দেখানো বা আন্ডার ইনভয়েসিং, আর হুন্ডি টাকা পাচারের জনপ্রিয় মাধ্যম। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটিসহ বিভিন্ন সংস্থা বলছে, প্রায় ৮০ শতাংশ অর্থ পাচার হয় এসবের মাধ্যমে। কিন্তু এই কৌশল প্রতিরোধে ব্যাংকের কিছু করার নেই, বরং যা করার তা কাস্টমসকেই করতে হবে বলে মত অর্থনীতিবিদদের। গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, কোন পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয়া সম্ভব নয়। আবার ব্যাংকের মাধ্যমেও মূল্য নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তাই যা করার কাস্টমসকেই করতে হবে। পরিমাণে অল্প হলেও, টাকা পাচারের নতুন মাধ্যম হয়ে উঠছে বিভিন্ন এ্যাপস। সম্প্রতি বিগো লাইভ ও লাইকির মাধ্যমে প্রতিমাসে শত কোটি টাকা পাচারের ঘটনাও সামনে এসেছে। দেশ উন্নত হচ্ছে, বাড়ছে জীবনযাত্রার মান। তবুও কেন বাড়ছে টাকা পাচার? এমন প্রশ্নের উত্তর হিসেবে ৫ কারণকে সামনে আনেন আহসান মনসুর। বলেন, বিনিয়োগের পরিবেশের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার শঙ্কা, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর দুর্বল নজরদারি, আইনের শাসনের ঘাটতি এবং বেপরোয়া দুর্নীতির ফল অর্থ পাচার।
জানা গেছে, গত ৫ বছরে অর্থ পাচারের ১০২৪টি প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইউ)। বিদেশী সংস্থার উপাত্তেও মিলেছে ভয়াবহ খবর। জিএফআইসহ বিভিন্ন সূত্র বলছে, ২০২০ সালে দেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের আমানত ৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ৮৪ বাংলাদেশীর টাকা পাচারের তথ্য এসেছে পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্সে। কিন্তু মামলা হয়েছে হাতে গোনা। জানতে চাইলে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলনে, ২০১৮-২০ এর মধ্যে ৭৭টি মামলা হয়েছে মানি লন্ডারিংয়ের। ৫০টি মামলা চার্জশীট হয়ে ট্রায়ালে আছে। আর বাকি ২৭টি মামলার তদন্ত হচ্ছে। এগুলো কোর্টে আসতে অনেক সময় লাগে, মামলা নিষ্পত্তি হতে অনেক সময় লাগে। প্রত্যেকটা ধাপ চ্যালেঞ্জ করা হয়। অর্থ পাচার রোধে আছে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন। সন্ত্রাসী অর্থায়ন বন্ধ ও টাকা পাচার প্রতিরোধে তথ্য লেদেনের জোট ১৫৯ দেশের এগমন্ড গ্রুপের সদস্যও হয়েছে বাংলাদেশ। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। জানতে চাইলে কোম্পানি আইন বিশ্লেষক ব্যারিস্টার এম এ মাসুম বলেন, ফিন্যান্স এ্যাক্ট ২০২০ এ বলা হয়েছিল, অপ্রদর্শিত টাকার ১০ শতাংশ দিলেই বৈধ করা যাবে। সেটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সেই সঙ্গে মানি লন্ডারিং এ্যাক্ট ২০১২ এর সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। এভাবে খোলা চেক দিয়ে দিলে মানি লন্ডারিং ঠেকানো যাবে না। দুদক মোট ৬০ ব্যক্তির অর্থ পাচারের তথ্য চেয়ে ১৮টি দেশে চিঠি দিয়েছিল। তার মধ্যে ৩০ জনের বিষয়ে তথ্য পেয়েছে দুদক।
সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের আমানত ৫ হাজার ২১৫ কোটি টাকা ॥ সুইজারল্যান্ডের ব্যাংক-গুলোতে বাংলাদেশী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থ থাকার হালনাগাদ পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত সম্প্রতি প্রকাশিত এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২০ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশের নামে রয়েছে ৫৭ কোটি ৩ লাখ সুইস ফ্রাঁ। বাংলাদেশী মুদ্রায় (প্রতি ফ্রাঁ ৯৫ টাকা ধরে) যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় পাঁচ হাজার ২১৫ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে ছিল ৬১ কোটি সুইস ফ্রাঁ বা প্রায় পাঁচ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ফলে আগের বছরের চেয়ে বাংলাদেশের নামে থাকা অর্থ কিছুটা কমেছে। তবে বাংলাদেশী গ্রাহকের নামে থাকা আমানত অনেক বেড়েছে। সুইস ব্যাংকে থাকা অর্থের একটি অংশ পাচার হয়ে থাকে বলে ধারণা করা হয়। তবে পাচার সম্পর্কে কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। এমনকি আমানত হিসেবে কার কত অর্থ আছে তাও জানা যায় না। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) প্রকাশিত পরিসংখ্যান সম্পর্কে বলেছে, এসব পরিসংখ্যানের সঙ্গে সম্পৃক্ত গ্রাহকের তথ্যের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা রাখা হবে। গোপনীয়তার স্বার্থে সব ডাটা সমন্বিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে। আলাদাভাবে কোন গ্রাহকের তথ্য নেই। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহাঃ রাজী হাসান বলেন, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশের নামে থাকা অর্থের বেশিরভাগই বৈদেশিক বাণিজ্যকেন্দ্রিক। গ্রাহকের আমানত হিসেবে যে অর্থ থাকে, তার মধ্যে সুইজারল্যান্ড এবং অন্য দেশে যেসব বাংলাদেশী থাকেন, তাদের অর্থও রয়েছে। গ্রাহক আমানতের একটি অংশ পাচার হয়ে যেতে পারে বলে সন্দেহ করা হয়। বিএফআইইউর কাছে এ বিষয়ে কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা এর আগে সুইজারল্যান্ডের এফআইইউর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু খুব একটা অগ্রগতি আসেনি। তিনি বলেন, আমরা প্রতিবছর বিভিন্ন সংস্থা থেকে অনেক তথ্য পাই। তার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন গোয়েন্দা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এসব দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পাঠানো হয়। অর্থ পাচার রোধে এসব পদক্ষেপ অব্যাহত আছে। যেহেতু অবৈধ অর্থ পাচার হয়, তাই অবৈধ অর্থ আয়ের পথ বন্ধ করতে সর্বাত্মক পদক্ষেপ নিতে হবে। সুইস ব্যাংকে কাদের টাকা আছে তা জানতে খুব শীঘ্রই তদন্তে নামছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
টাকা পাচার বন্ধে আসছে নতুন আইন, মৃত্যুদন্ডের বিধান রাখার দাবি ॥ অর্থ পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশের প্রথম সরাসরি আইন ‘মানি লন্ডারিং আইন-২০০২’। শাস্তি ছিল কমপক্ষে ছয়মাস, সর্বোচ্চ সাত বছর জেল। আর অপরাধের সঙ্গে জড়িত অর্থের দ্বিগুণ জরিমানা। এর পরের আইন হয় ২০০৯ সালে। কারাদন্ডের শাস্তি একই রকম থাকলেও, অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তি পুরোটাই বাজেয়াফতের বিধান রাখা হয়। পুরনো আইন বাতিল করে ২০১২ সালের জানুয়ারিতে কার্যকর হয় নতুন আইন। বাড়ানো হয় জেল-জরিমানা-দুটোই। কিন্তু, তাতেও সন্তুষ্ট নন আইনজীবীরা। দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান জানান, বর্তমান আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ সাজার মেয়াদ যথেষ্ট নয়। টাকা পাচার রোধে যাবজ্জীবন অথবা মৃত্যুদন্ডের বিধান কার্যকরের দাবি জানান এ আইনজীবী। তাই উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে নতুন আরও একটি আইন তৈরি করার। সংশোধন হবে আরও কয়েকটি পুরনো আইনের।
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালে মানি লন্ডারিং আইন সংশোধনের আগ পর্যন্ত ২৭ ধরনের অপরাধ থেকে টাকা পাচারের অনুসন্ধান ও তদন্তের দায়িত্বে ছিল একমাত্র দুদক। এখন কেবল একটি, শুধু ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ পাচার দুদকের এখতিয়ারভুক্ত। বাকিগুলোর দায়িত্বে এনবিআর, সিআইডি, বিএসইসি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশ অধিদফতর।
পূর্ববর্তী পোস্ট