ডাঃ এজাজ বারী চৌধুরী
ছোটবেলায় একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, কোথা থেকে এক জীর্ণশীর্ণ, লোমওঠা, মৃতপ্রায় কুকুর বাড়ীর গেটের সামনে এসে শুয়ে আছে৷ দেখে খুব মায়া লাগলো৷ আম্মুর কাছ থেকে বাসি কিছু খাবার দাবার একটা ভাঙ্গা প্লেটে এনে কুকুরটার মুখের কাছে রাখলাম৷ বেচারার তখন খাওয়ার শক্তিও বোধহয় ছিলনা৷ প্রথমেই সে আমার দিকে তাকিয়ে… লেজটা দূর্বলভাবে কয়েকবার নাড়লো৷ তারপর বহু কষ্ট করে, আস্তে আস্তে খেতে লাগলো৷ এভাবে নিয়মিত কয়েকদিন খাবার খাইয়ে কুকুরটাকে সুস্থ করে তুললাম৷
এরপর কুকুরটাকে তাড়িয়ে দেবার পালা৷ কিন্তু বিপদ হল, কিছুতেই তাকে তাড়ানো যাচ্ছিল না৷ লাথি দিতাম — কুঁই কুঁই করে ভয়ে কিছুদূর দৌড়ে পালাতো…. তারপর দূর থেকেই আমার দিকে তাকিয়ে খুশীতে গদগদ হয়ে লেজ নাড়তো৷ এরপর খাবার দেয়া বন্ধ করে দিলাম৷ বেচারা… মনখারাপ করে খাবারের অপেক্ষা করতো, কিন্তু কখনো চিৎকার চেঁচামেচি করতো না৷ তারপর ক্ষুধার জ্বালায় অতিষ্ট হয়ে গেলে, কিছুক্ষণের জন্য হাওয়া হয়ে যেত৷ হয়তো কোথাও থেকে কিছু খাবার জুটিয়ে, আবার এসে বসে থাকতো বাড়ীর সামনের উঠোনে৷ এভাবে বেশ কিছুদিন পার হলো৷
একদিন সকালে উঠে দেখি, কুকুরটা নেই৷ কেমন অস্থিরতা শুরু হল বুকের ভেতর৷ মনকে বোঝালাম, হয়তো খাবার খুঁজতে আজ দূরে কোথাও গেছে ও — চলে আসবে৷ কিন্তু না, আমার প্রতিদিনকার অপেক্ষাকে উপহাস করে, সে আর ফিরে এলো না৷
খুব খারাপ লাগতো মাঝে মাঝে … কি ই বা দিয়েছিলাম আমি তাকে?? কয়েকদিন কিছু বাসী খাবার — যা হয়তো এমনিতেই ফেলে দিতে হতো৷ অথচ এর প্রতিদানে সে দিয়েছিল, তার হৃদয় নিংড়ানো বন্ধুত্ব… আনুগত্য … আর কৃতজ্ঞতা!
অনেকদিন পর একদিন সকালে কুকুরটিকে আবার পেলাম … সেই উঠোনে … একই যায়গায়! কিন্তু এবার তার প্রাণহীন নিথর দেহটা শুধু পড়ে আছে!! অনেক কেঁদেছিলাম সেদিন — বেচারা আমার বন্ধুটা! মৃত্যু আঁচ করতে পেরেই হয়তো ফিরে এসেছিল… তার সবচেয়ে আপন মানুষটির কাছে! কিন্তু দেখা করে যেতে পারলোনা! ছোটবেলার এই ঘটনার গভীর প্রভাবেই হয়তো আমি আস্তে আস্তে কুকুর হয়ে যেতে থাকলাম৷ যার কাছ থেকে কিছুটা হলেও উপকার পাই — তার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধটা যেন শেষই হতে চাইতোনা৷ সে যদি পরে কখনো লাথিও দিতো … তবুও প্রতিশোধ না নিয়ে, অপেক্ষায় থাকতাম আবার তাকে বন্ধু হিসেবে পাবার৷ শুধুমাত্র মেডিকেল লাইফের শেষের এক বছর… politics এ জড়িয়ে… “মানুষ” হয়ে গিয়েছিলাম! সেই সময়ের করা ভুলগুলো, আজীবন আমাকে অনুতাপের আগুনে পুড়িয়ে যাবে!!
ছোটবেলা থেকেই প্রাইভেট পড়তাম৷ স্যারদের টাকা দেবার সময় কোনদিনও মনে আসেনি … উনারা চামার কিংবা শিক্ষা ব্যবসায়ী! বরং টাকাগুলো দেবার পর মনে কিছুটা শান্তি আসতো… কিছুটা গুরুদক্ষিণা তো দিতে পারলাম!! এরপর শুরু হলো মেডিক্যাল লাইফ৷ এখানে তো প্রাইভেট পড়ার টাকাটাও লাগেনি কখনো…. শুধুমাত্র স্যারদের ত্যাগ-তিতিক্ষা আর মহত্বের জন্য! সেসব স্যাররা অনেকেই গভীর রাত পর্যন্ত চেম্বার করতেন… কিন্তু ঘুমিয়ে, না ঘুমিয়ে … ঠিকই আবার সাত সকালে ছুটে আসতেন Lecture Gallery তে আমাদের পড়ানোর জন্য! শুধু তা-ই না… ওয়ার্ডে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে আমাদের পড়াতেন, শেখাতেন…, মানুষকে সেবা করার উৎসাহ দিতেন!
কি পেয়েছেন তারা … আমাদের পেছনে এত পরিশ্রম করে — কিংবা কোন কিছু পাবার আশায় কি তারা আমাদের পড়িয়েছিলেন এবং শিখিয়েছিলেন? বছরের পর বছর পড়িয়েছেন — কোন বেতন নেননি, রোগী হিসেবে দেখেছেন — কোন ভিজিট নেননি, বাবা-মায়ের চিকিৎসাও করে দিয়েছেন — নামমাত্র মূল্যে!! এভাবে জীবনে সবচেয়ে বেশী কৃতজ্ঞতার বাঁধনে যাদের কাছে বাধা পড়ে আছি… আল্লাহ্ বোধহয় কোন সুযোগই রাখেননি তাদের ঋণ পরিশোধ করার … সারাজীবন শুধু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে যাওয়া ছাড়া! এজন্য উনাদের মধ্যেই যদি কেউ কখনো দয়াপরবশ হয়ে ভিজিট রাখতেন … তখন মনটা একটু স্বস্তি পেত — যাক ঋণের পাল্লাটা তো, আর ভারী হলোনা!
কুকুর হতে পেরেছি বলেই হয়তো সব স্যারদের প্রতিই একই রকম শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা কাজ করে আমার৷ কেননা আমাকে না পড়ালেও … আমার মতো শত শত ছাত্রের জন্য তিনি শ্রম দিয়েছেন — তাদেরকে ডাক্তার বানিয়েছেন! মাত্র ২/৩ মাস আগে Platform এ যুক্ত হয়েছিলাম৷ মনটা বেশ ফুরফুরে ছিল, এই ভেবে যে … বিশাল Doctor community দিয়ে গাঁথা এক অচ্ছেদ্য মালার সাথে যুক্ত হতে পারলাম৷ কিন্তু খুব কষ্ট হয় যখন দেখি, এখানে হলুদ সাংবাদিকতা থেকেও অনেকগুন হলুদ কিছু লেখাও অনায়াসে approval পায়! মূল ঘটনাকে বিকৃত করে, সত্য লুকিয়ে রেখে… অন্যের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোই থাকে লেখাগুলোর উদ্দেশ্য এবং সেগুলোতে সাড়াও পড়ে প্রচুর৷
যেমনঃ (১) এক ইন্টার্ণ নাকি কার কাছে শুনেছে, অমুক ভাই ঔষধ কোম্পানি থেকে AC পাবে …. আর অমনি দাও Platform এ পোষ্ট! Admin রা একবারও ভাবেনা, এরকম unauthentic, rumor কিংবা শোনা কথা… পত্রিকায় ছাপলে সেটা হয় হলুদ সাংবাদিকতা… কিন্তু Platform এ এসব লেখা হয়ে ওঠে, Exclusive!
(২) আরেক বিশিষ্ট ভদ্রলোক … যার স্যার তার কাছ থেকে ভিজিট কবুল করার মত বিশাল অপরাধ করে ফেলেছিলেন… এবং সেই স্যারকে জনমের মতো শায়েস্তা করতে তিনি post দিলেন, “স্যার হাত পেতে বসেছিলেন … তার কাছ থেকে ভিজিট নেবার জন্য!” এই গল্পের শিশুতোষ ফাঁকগুলোও Admin দের নজরে আসলোনা?! ঢাকার প্রায় সব হাসপাতাল আর ল্যাব গুলোতেই এখন centrally money receipt কেটে ডাক্তার দেখাতে হয়, ডাক্তারদের নিজ হাতে ভিজিট নেবার কোন সুযোগই নেই৷ আর যেখানে এই system নেই… সেসব ক্ষেত্রেও কোন Professor নিজে ভিজিট নেননা… তাঁর attendant রা নেন৷ তারপরও যদি অতি rare কোন স্যার নিজেই ভিজিট নেন, তিনি তো হাত দিয়েই সেটা নেবেন… পা দিয়ে তো আর নেবেন না! এটাকে কি হাত পেতে বসে থাকা বলে???
(৩) খুবই বিস্ময়কর পোষ্ট ছিল এটা… শুধুই হেডলাইন, ভেতরে কোনই details বা contents নেই!….
” যখন বড় স্যার পিয়নের কথায় ২ জন ডাক্তারে মা (২ জন ডাক্তার ই উপস্থিত ছিলাম) এর চিকিৎসা করতে মানা করেন তখন মনে হয় মরে যাই।”
…. এটাকেও details ছাড়া, verification ছাড়া approve করে দেয়া হলো৷ ভেতরে বহু comments ঘেটে … (যার বেশীরভাগই ওই স্যারকে দেয়া গালি এবং উনাকে মারার অতি প্রয়োজনীয়তা সংক্রান্ত আলোচনা)….. প্রকৃত ঘটনার চিত্রটি আন্দাজ করলাম!
সূত্রটি ছিল, খুবই দায়সারা ভাবে লেখা এবং চোখেই পড়েনা এমন একটি লাইন… “তারপর অবশ্য স্যার procedure করেছিলেন”৷
আমি জানতে চাইলাম, স্যারের deny করা আর operation করে দেবার মধ্যকার সময়ের ব্যবধান কত ছিল? উত্তর এল, প্রায় ১ ঘন্টা৷ That means…. OT ready, wash নেয়া এগুলো বাদ দিলে… deny করার maximum ১৫ মিনিটের মধ্যেই স্যার আবার অপারেশন করতে রাজী হয়েছিলেন!! যেই অপ্রীতিকর ঘটনাটি পপুলার এ ঘটেছিল, তাতে স্যারের বিন্দুমাত্র involvement ও ছিলনা৷ উনার দোষ ছিল শুধু ওইটুকুই… প্রথমে রাগের মাথায় operation করতে deny করা!!
যার আপন মা … আমাকে সেই ডাক্তারের দেয়া reply এর অংশবিশেষ, ” আমাদের স্যারের প্রতি কোন ক্ষোভ রাগ কিছুই ছিলো না যা ছিলো এবং আছে তা শুধুই হসপিটালের মিসমেনেজমেন্টের উপর..” (copy-pasted) অথচ পুরো post টির একমাত্র victim ছিলেন স্যার… উনাকে দেয়া অন্যদের শত শত ঘৃণাভরা comments কিন্তু দুই ডাক্তার ই enjoy করে যাচ্ছিলেন… প্রতিবাদ বা কাউকে নিষেধ করেননি একবারও!!! আমার comments এর পর আবারো স্যারকে সম্ধোধন করা হয়েছে, “কুকুর” বলে… আর আমাকে offer করা হয়েছে, “দুই গালে জুতার বাড়ি!”
এই হলো আমাদের কৃতজ্ঞতার নমুনা! যার চিকিৎসা নিই… যার সেবায় মা সুস্থ হয়ে ঘরে ফেরেন… সত্য গোপন করে, ছলনার আশ্রয় নিয়ে, তার নামেই ঘৃণার বিষ ছড়াই!! এই একই কাজ, যদি আজ কোন পত্রিকা করতো… আর সত্যটা না বুঝেই, মানুষের ঘৃণা ওই স্যার পেতেন … তাহলে আপনারা কি বলতেন???
এজন্যই আজ এতবছর পর, আমার সেই কুকুরটার কথা খুব মনে পড়ছে! একটা বিবেকহীন পশু হয়েও, আমার প্রতিদিনের লাথি খেয়ে… তার স্বজাতির কাছে কখনো আমার নামে সত্য-মিথ্যা নালিশ করতে যেতোনা, কিংবা …. আরো ৫টা কুকুরকে ডেকে এনে, একসঙ্গে সবাই মিলে আমাকে ঘেউ দিতোনা!!!
লেখক- ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ
বিএসডি