দেশের রফতানি আয়ের সবচেয়ে বড় যোগানদাতা পোশাকখাতে আসন্ন ঈদুল ফিতরের বেতন ও বোনাস নিয়ে জটিলতা তৈরি হতে পারে। বড় কারখানাগুলোতে এ জটিলতার সম্ভাবনা কম থাকলেও ছোট কারখানায় অসন্তোষেরও আশঙ্কা রয়েছে, বিশেষ করে বোনাসের ক্ষেত্রে।
শ্রমিক সংগঠনগুলো বলছে, মে মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই শ্রমিকদের বেতন ও বোনাস পরিশোধ করতে হবে, যেন তারা ঈদের কেনাকাটা করার সুযোগ পান। সেইসঙ্গে শ্রম প্রতিমন্ত্রী আগামী ১০ মে’র মধ্যে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা-বোনাস পরিশোধ করার যে আহ্বান জানিয়েছেন, তা প্রত্যাখ্যান করেছে কয়েকটি শ্রমিক সংগঠন।
অন্যদিকে পোশাক মালিকরা বলছেন, সাধারণত ঈদের আগে কারখানাগুলোতে কাজের চাপ থাকে। এ অবস্থায় আগেই শ্রমিকের বেতন দেয়া হলে তাদের অনেকেই কাজ ছেড়ে গ্রামে চলে যান। এতে রফতানিতে বাধা পড়ে, কারখানাগুলো সময়মতো পণ্য শিপমেন্ট করতে পারে না। তবে ঈদের আগেই বেতন-বোনাস পাবেন শ্রমিকরা।
গোয়েন্দা সংস্থার একটি তথ্য বলছে, বেতন নিয়ে কারখানাগুলোতে কোনো সমস্যা তৈরি না হলেও বোনাসের ক্ষেত্রে অনেক কারখানায় জটিলতা হতে পারে। এক্ষেত্রে ছোট কারখানাগুলোতেই এ সমস্যা তৈরি হতে পারে বেশি। সাবকন্ট্রাক্টে কাজ করা কারখানাগুলো (রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের পোশাক তৈরির কাজ পাওয়া কারখানা) বোনাস দিলেও হয়তো বেতনের অর্ধেক দেবে।
এদিকে পোশাক মালিকদের তিন সংগঠন বিজিএমইএ, বিটিএমএ এবং বিকেএমইএ শ্রমিক-কর্মচারীদের এপ্রিল, মে ও জুন মাসের বেতন-ভাতা ও আসন্ন ঈদ বোনাস দেয়ার জন্য আগের মতো সহজ শর্তে ঋণ দিতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে। ছয় হাজার কোটি টাকার এ ঋণ সহায়তা চেয়ে তারা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর আবেদন পাঠিয়েছে।
আবেদনে তিন সংগঠন বলেছে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ধীরে ধীরে হ্রাস হবে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে আসবে এটাই সবার কাম্য ছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাপী পুনরায় শুরু হয়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। বিশ্বের অনেক দেশেই আগের মতো লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। যার ফলে যেসব ক্রেতা পেমেন্ট দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তারাও পেমেন্ট দিতে অপারগতা প্রকাশ করছে।
সংগঠন তিনটি আরও বলেছে, এমতাবস্থায় আসন্ন ঈদে সচল কারখানাগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও বোনাস দেয়ার জন্য রফতানিকারকদের ওপর প্রচণ্ড চাপ রয়েছে। উদ্যোক্তাদের আর্থিক সংকটের কারণে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা ও বোনাস পরিশোধের জন্য অর্থের যোগান দেয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এরূপ পরিস্থিতিতে রফতানিমুখী পোশাকশিল্পকে সহায়তা করার জন্য শ্রমিক-কর্মচারীদের এপ্রিল, মে ও জুন মাসের বেতন-ভাতা ও বোনাস প্রদানের জন্য আগের মতো সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা একান্ত আবশ্যক।
গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্র জানিয়েছে, বড় কারখানাগুলোতে বেতন-বোনাস নিয়ে তেমন জটিলতা হয়তো হবে না। তবে ছোট কারখানাগুলোতে জটিলতা তৈরির শঙ্কা রয়েছে। অর্ডার বাতিল, শিপমেন্ট নেই, পণ্যের পেমেন্ট না পাওয়ার অজুহাতে তারা বেতন-বোনাস দিতে অপারগতা প্রকাশ করতে পারে।
এ বিষয়ে বিজিএমইএ’র নব-নির্বাচিত বোর্ডের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘এবার জটিলতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যেসব কারখানা সমস্যায় রয়েছে তাদের ব্যাপারে সমাধান দিতে সরকারের কাছে আবেদন করা হয়েছে। আশা করছি, সরকারের পক্ষ থেকেও একটা সুবিধা আসবে।’
ছোট কারখানাগুলোর সমস্যা নিয়ে তিনি বলেন, ‘সেখানে অর্ডার বাতিল হয়েছে, পণ্যের দাম এখনো অনেকে পায়নি। তবে আমাদের পক্ষ থেকে সমাধান করা হবে যাতে জটিলতা না হয়। কিন্তু সাবকন্ট্রাক্ট কারখানা নিয়ে আমাদের কিছু করার নেই। আমরা শুধু সদস্যভুক্ত কারখানাকেই সহযোগিতা করতে পারি।’
এদিকে আসন্ন ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে আগামী ১০ মে’র মধ্যে পোশাকসহ সব খাতের শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধের আহ্বান জানিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মুন্নুজান সুফিয়ান। শ্রমিকদের আগের কোনো মাসের বেতন যদি বকেয়া থাকে, সেসব বেতনও পরিশোধ করার কথা বলেন তিনি। গত ২৯ এপ্রিল শ্রম ভবনের সম্মেলন কক্ষে ত্রিপক্ষীয় পরামর্শক কমিটির সভায় সভাপতির বক্তব্যে মালিকদের প্রতি তিনি এ আহ্বান জানান।
তবে ১০ মে’র মধ্যে বেতন-বোনাস প্রদানে শ্রম প্রতিমন্ত্রীর ওই আহ্বানের নিন্দা জানিয়ে শ্রমিক নেতারা, মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে এক মাসের সমপরিমাণ (পূর্ণ) ঈদ বোনাসসহ এপ্রিল মাসের বেতন পরিশোধের দাবি জানিয়েছেন।
শ্রমিক নেতা কামরুল আহসান বলেন, ‘আগামী ৭ ও ৮ মে শুক্র-শনিবার এবং ১০ মে শবে কদরের জন্য ব্যাংক বন্ধ। যা মালিকদের অজুহাত তৈরির সুযোগ করে দেবে। সুযোগ সন্ধানী মালিকরা ঈদের নিকটবর্তী সময়ে শ্রমিকদের পরিবারের সঙ্গে মিলিত হয়ে উৎসব করার আকাঙ্ক্ষার সুযোগ নিয়ে বরাবরের মতো তাদের ন্যায্য প্রাপ্য বেতন-বোনাস থেকে বঞ্চিত করবে। পোশাকশিল্প মালিকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সরকার শ্রমিকদের পুনরায় বঞ্চিত করার পথ উন্মুক্ত রাখল।’
গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (জি-স্কপ) যুগ্ম-সমন্বয়ক আব্দুল ওয়াহেদ বলেন, ‘১০ মে নয়, মে মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই শ্রমিকদের এক মাসের মূল মজুরির সমান ঈদ বোনাসসহ এপ্রিল মাসের মজুরি পরিশোধ করতে হবে। আর সময়মতো বেতন-বোনাস পরিশোধ না করার কারণে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির উদ্ভব হলে তার দায় পোশাকশিল্প মালিকদের নিতে হবে।’
তবে মালিকপক্ষ বলছে ঈদের আগ মুহূর্তে কারখানায় কাজের চাপ বেশি থাকে। আবার আগেই ঈদ বোনাস-বেতন দিয়ে দিলে অনেক শ্রমিক গ্রামে চলে যান। এতে কারখানা সময় মতো পণ্য ডেলিভারি দিতে পারে না।
এ বিষয়ে বিকেএমইএ’র সহ-সভাপতি এবং ফতুল্লা অ্যাপারেল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘আইন অনুযায়ী সাত কর্মদিবস অর্থাৎ ১০ মে’র মধ্যে বেতন দিতে হবে, তবে ঈদের সময়ে অনেক কারখানা ২/১ দিন দেরিতে ছুটির দিন বেতন দিয়ে থাকে, যেন আগে বেতন পেয়ে শ্রমিকরা ঈদ শপিংয়ের জন্য কাজে অনুপস্থিত না থাকে, কারণ শেষ মুহূর্তে কাজের একটু চাপ থাকে।’