নিজস্ব প্রতিবেদক:
যে ব্যাংক আমানতকারীর টাকা ফেরত দিতে পারে না, সেই ব্যাংক আবার সুদও মওকুফ করে। ঘটনাটি ঘটেছে চতুর্থ প্রজন্মের একটি ব্যাংকে। শুধু গত ২১ মাসেই ১৯ কোটি ৬০ লাখ টাকার সুদ মওকুফ করেছে ব্যাংকটি। এ চিত্র শুধু এক ব্যাংকে নয়, পুরো ব্যাংক খাতের। গত ১০ বছরে ব্যাংক খাতে এ ধরনের সুদ মওকুফ করা হয়েছে ২৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংক ব্যবসার মূল উৎস জনগণের আমানত। সাধারণ মানুষ থেকে আমানত সংগ্রহ করে তা ঋণ হিসেবে বিতরণ করা হয়। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো সুদ অথবা মুনাফা নামে আয় করে। যে কোনো ব্যাংকের মোট আমানতের প্রায় ৯০ শতাংশ আসে সাধারণ গ্রাহকের কাছ থেকে। সে অর্থে ব্যাংকের প্রকৃত মালিক আমানতকারীরা-এমন মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের।
তাদের মতে, যদিও বাস্তবে তার কোনো স্বীকৃতি নেই। উলটো ১০ শতাংশ শেয়ারধারীই ছড়ি ঘুরান সব সময়। ক্ষেত্রবিশেষ আমানতকারীরা তাদের জমানো টাকাও ফেরত পান না। সুদ মওকুফ সুবিধার কারণে ব্যাংকের নিট আয় এবং আমানতকারীদের সুদ আয় কমে যায়। এতে ডিভিডেন্ড (লভ্যাংশ) কম হয়, পাশাপাশি সরকারও রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। তবে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা সুদ মওকুফের সুবিধা খুব বেশি পান না। এখানেও প্রভাবশালীদের হাত। এ সুবিধার বেশিরভাগই ভোগ করেন রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা। এতে আমানতকারীরা লোকসানে পড়েন।
বিশেষজ্ঞদের আরও অভিমত-সব সময় বড় ঋণখেলাপিরা বেশি সুদ মওকুফ-সুবিধা পান। ক্ষুদ্র ও মাঝারি গ্রাহকরা এ সুবিধা থেকে অনেক দূরে থাকেন। কারণ তারা প্রভাব বিস্তার করতে পারেন না। এ প্রক্রিয়ার একটি কুফল হচ্ছে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। তাই ঋণের সুদ মওকুফের একটি নীতিমালা থাকা জরুরি। এতে বোঝা যাবে, কে এই সুবিধা পাওয়ার যোগ্য আর কে যোগ্য নন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ২৩ হাজার ১৬৬ কোটি ১২ লাখ টাকার সুদ মওকুফ করেছে ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে সরকারি ব্যাংকে ১৪ হাজার ৫৭৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা এবং বেসরকারি ব্যাংকে ৮ হাজার ৫৮৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা রয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১২ সালে ২৮ হাজার ৯০৮টি হিসাবের বিপরীতে সুদ মওকুফ করা হয়েছে ১ হাজার ৩২ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এরপর ধারাবাহিকভাবে ২০১৩ সালে ৩৪ হাজার ৮৪২টি হিসাবের বিপরীতে ৯৬৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা, ২০১৪ সালে ৪৪ হাজার ৪১৬টি হিসাবের বিপরীতে ১ হাজার ২৪৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, ২০১৫ সালে ৩৭ হাজার ২৫৪টি হিসাবের বিপরীতে ১ হাজার ৩৮০ কোটি ৬৭ লাখ টাকার সুদ মওকুফ করা হয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, সুদ মওকুফের সুবিধা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা পান না। এটা মূলত প্রভাবশালীদের কাজ। যাদের প্রতি ব্যাংকের দুর্বলতা আছে, এমন গ্রাহকই সাধারণত এ ধরনের সুবিধা পেয়ে থাকেন। এতে ব্যাংকের ক্ষতি। ব্যাংকের আয় কমে যায়। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের খতিয়ে দেখা উচিত।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ২০১৬ সালে ৩৩ হাজার ৯৭১টি হিসাবের বিপরীতে সুদ মওকুফ করা হয়েছে ৯৬৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। ২০১৭ সালে সুদ মওকুফ করা হয় ১ হাজার ৯০০ কোটি ৯৭ লাখ টাকার। ২৮ হাজার ৭৬৮টি হিসাবের এই সুদ মওকুফ করা হয়েছিল। এরপর পর্যায়ক্রমে ২০১৮ সালে ২১ হাজার ৭৭৫টি হিসাবের বিপরীতে ২ হাজার ২৩৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা।
তবে গত তিন বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই কয়েক বছর সুদ মওকুফের অংক আগ্রাসীভাবে বেড়েছে। তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালে ২১ হাজার ৬৪০টি হিসাবের বিপরীতে সুদ মওকুফ করা হয়েছে ৩ হাজার ৬৩৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকার, ২০২০ সালে মাত্র ১৭ হাজার ৭৭৫টি হিসাবের বিপরীতে ৪ হাজার ৯২১ কোটি ৫৭ লাখ টাকার সুদ মওকুফ করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০২১ সালে ২২ হাজার ২০৬টি হিসাবের বিপরীতে ৪ হাজার ৮৭৭ কোটি ২১ লাখ টাকার সুদ মওকুফ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, যে প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষের সঞ্চিত আমানত ফেরত দিতে পারে না। আবার বিতরণ করা ঋণের সুদও আদায় করতে পারে না, যা শেষ পর্যন্ত মাফ করে দেওয়ার অবস্থায় চলে যায়; সে প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রেখে কী লাভ? কারণ এ ধরনের প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর লোকসানের ঘানি টানতে টানতে শেষ হয়ে যায়। এতে উপকারের পরিবর্তে অপকারই বেশি হয়।
জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, সুদ মওকুফের বিধান আছে। বৈশ্বিকভাবে এর চর্চা হয়। তবে এটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পেয়ে থাকেন প্রভাবশালীরা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা বঞ্চিত হন। এখানে ভারসাম্য থাকা উচিত।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শফিকুর রহমান বলেন, সুদ মওকুফ টাকা আদায়ের একটা প্রচলিত পন্থা। তবে মনে রাখতে হবে-এ সুবিধা যেন প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত এবং ভালো উদ্যোক্তাদের বাইরে না যায়।
জানা গেছে, ব্যাংকের মুনাফায় আঘাত আসে বলে ব্যাংকার সুদ মওকুফ করতে চান না। তবে পরিচালনা পর্ষদ চাইলেই সুদ মওকুফ করতে পারে। সাধারণত গ্রাহকের মৃত্যু, সিকিউরিটিবিহীন ঋণ, অপর্যাপ্ত সিকিউরিটির ঋণ, দীর্ঘদিন যাবৎ খেলাপি ঋণ, দীর্ঘদিনের মামলাধীন, বারবার চেষ্টার পরও নিলামে সিকিউরিটি বিক্রিতে ক্রেতার অভাব, ত্রুটিপূর্ণ ডকুমেন্টেশনসহ বিভিন্ন কারণে সুদ মওকুফ করা হয়। কিন্তু কোন পর্যায়ে কতটুকু সুদ মওকুফ করা যাবে, তার কোনো বিধিবিধান বর্তমানে নেই। তাই ব্যাংকের ব্যবস্থাপক যখন আলাপ-আলোচনায় (নেগোসিয়েশন) বসেন, তিনি কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না।
ব্যাংকিং কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ধারা-৪৯ (চ)-তে বলা হয়েছে, ‘ঋণ শৃঙ্খলার স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংক সাধারণভাবে সব ব্যাংক-কোম্পানি বা কোনো বিশেষ ব্যাংক-কোম্পানি বা বিশেষ শ্রেণির ব্যাংক-কোম্পানির জন্য ঋণ শ্রেণিকরণ ও সঞ্চিতি সংরক্ষণ, ঋণ মওকুফ, পুনঃতফসিলীকরণ কিংবা পুনর্গঠনসংক্রান্ত বিষয়সমূহে বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণীয় নির্দেশ প্রদান করিতে পারিবে।’ ওই বিধান মোতাবেক বাংলাদেশ ব্যাংক ১৯৯১ সালের ৭ অক্টোবর এক নির্দেশনায় বলে, প্রত্যেক ব্যাংক তাদের নিজস্ব নীতিমালার মধ্যে সুদ মওকুফ করতে পারবে, তবে আসল (প্রিন্সিপাল) মওকুফ করা যাবে না।
এ নির্দেশনার আলোকে ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজন মোতাবেক সুদ মওকুফ করে আসছে। কোনো কোনো ব্যাংক শ্রেণিকৃত ঋণের কিংবা মামলাধীন ঋণের স্থগিত সুদের অর্ধেক মওকুফ করে এবং ক্ষেত্রবিশেষে স্থগিত সুদের পুরোটাই মওকুফ করে। কিছু ব্যাংক বিশেষ বিবেচনায় আয় খাতে আকলিত সুদ মওকুফ করলেও বেশিরভাগ ব্যাংক পারতপক্ষে তা করে না। অনেক ক্ষেত্রে সহায়ক জামানতের (কোলেটারেল সিকিউরিটি) বাজারমূল্য ঋণের অঙ্কের চেয়ে বেশি হলে সে ক্ষেত্রে গ্রাহকদের সুদ মওকুফ-সুবিধা দেওয়া হয় না।
উচ্চ আদালতে রিটের কারণে ব্যাংকের মামলা যদি বেশ কয়েক বছর যাবৎ নিষ্পত্তি না হয়, শেষ পর্যন্ত গ্রাহক যদি সুদ মওকুফ পেয়ে আসল দিতে রাজি হন, তখন ব্যাংকার মামলার কষ্টের কথা বিবেচনা করে মওকুফ সুবিধা প্রদান করেন। আর যে গ্রাহক নানা প্রতিকূলতার কারণে ঋণ শোধ করতে পারেন না, কিন্তু ব্যাংকের ঋণ শোধে তার আন্তরিকতা আছে বলে মনে হয়, সে ক্ষেত্রে ব্যাংকার তাকে সুদ মওকুফ সুবিধা দিয়ে দায় থেকে রেহাই দেন।
বিএসডি/ এমআর