ডা.মুহাম্মদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ: শীতের আগমন ঘটেছে দেশে। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথেই আমাদের মাঝে নানা রোগব্যাধির প্রবণতা বেড়ে যায়। আমাদের মৌসুমি জলবায়ুর দেশে প্রতিটি ঋতু পরিবর্তনের সময়ই দেখা যায় আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন। আবহাওয়ার এই পরিবর্তনের সাথে সাথে শিশুসহ সকল বয়সের মানুষের মধ্যে রোগাক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা অনেক বৃদ্ধি পায়। এই অসুখের কারণ হলো, আবহাওয়ার এসব পরিবর্তন রোগের নানা উপলক্ষকে করে ত্বরান্বিত যার ফলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ।
আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবেশে তাপমাত্রার তারতম্য আসে। আর এই তারমাত্রার তারতম্য নানা ধরণের রোগ জীবাণুর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলে। শীতকালে শুষ্কতার জন্য অ্যালার্জির প্রবণতা অনেক বেড়ে যায়। শুষ্কতায় ত্বক ফাটা, অ্যাকজিমা, সোরিয়াসিস ছাড়াও ঠাণ্ডা, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যাও বেড়ে যায়। ঋতু পরিবর্তনের সাথে আসে ফ্লু জাতীয় বিভিন্ন ছোঁয়াচে রোগ যা খুব দ্রুত একজন থেকে অন্যজনে ছড়িয়ে পড়ে। ঠাণ্ডা বা সর্দির জন্য দায়ী রাইনো ভাইরাস বা করোনা ভাইরাসও একটু ঠাণ্ডা আবহাওয়া থাকলেই দ্রুত ছড়ায়। আবার শীতের শুষ্ক বাতাসে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের বিস্তার ঘটে দ্রুত এবং সংক্রমণ হওয়ার প্রবণতাকে ত্বরান্বিত করে। ব্যাক্টেরিয়াজনিত ইনফেকশন এবং সাইনাস এর সমস্যাও এই সময় বেড়ে যায়। শুকনো বাতাসে ধুলাবালি বেড়ে গিয়ে নানা ধরণের অ্যালার্জির সমস্যাও সৃষ্টি হয়। ঋতুর পরিবর্তন মূলত একটা উপলক্ষ। এসময় নানা জীবাণুর আক্রমণ ও পরিবেশের পরিবর্তনজনিত কারণেই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয় যার সাথে আমাদের শরীর ঠিক মানিয়ে নিতে পারে না। তাই ঋতু পরিবর্তনের সময় সুস্থ থাকার জন্য চাই সচেতনতা, পর্যাপ্ত ঘুম, শরীরচর্চা ও পরিচ্ছন্ন থাকা। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে যা শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তুলবে। শীত মৌসুমে নানা বয়সের মানুষের নানা রোগে আক্রান্ত প্রকোপ বেড়ে যায়। তাই শীত মৌসুমে সবাইকেই আরামদায়ক জীবনযাপনের জন্য একটু বেশি সতর্ক ও সচেতনতা হতে হয়। তবে মনে রাখবেন, সতর্কতা ও সচেতনতা অনেক রোগের আক্রমণ থেকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখে।
শীত মৌসুমে আমাদের যেসব রোগের প্রকোপ বেড়ে যায় এগুলো হলো : সর্দি, কাশি, জ্বর, নিউমোনিয়া, হাঁপানি, চর্মরোগ ও বাতব্যথা রোগ। সর্দি কাশি : ঋতু পরিবর্তনের শুরুতে প্রায় সব লোকই কমবেশি সর্দি কাশিতে ভুগে থাকেন। তার সাথে যুক্ত থাকে জ্বর। নাক দিয়ে বারবার পানি ঝরতে থাকে এবং হাঁচি হয়। মাঝে মধ্যে মাথা ব্যথা, শরীরে ব্যথা, গলা ব্যথা এগুলো সাধারণ রোগ। এ রোগগুলো সাধারণ উপসর্গ দেখা দেয়। ইনফ্লুয়েঞ্জার মাধ্যমে এ রোগগুলো হয়। তা ছাড়া ভাইরাসজনিত কারণেও এ ধরনের রোগ দেখা দিতে পারে। সাধারণত যাদের শরীরে এন্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তারাই এ রোগে বেশি ভোগে। ভাইরাসের আক্রমণে দেহের দুর্বলতার সুযোগে ব্যাকটেরিয়াও আক্রমণ করতে পারে। আপনার সর্দি যদি খুব ঘন হয় বা হলুদাভ বা কাশির সাথে হলুদাভ বর্ণের কফ আসে তাহলে ধরে নেবেন আপনি ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। খুব বেশি জ্বর, গলাব্যথা এবং কাশি থাকলে অবশ্যই আপনাকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
করণীয়: সর্দি কাশিতে আক্রান্ত হলে অন্যদের সাথে বিশেষ করে শিশুদের সাথে মেলামেশা ওঠাবসা খুব সতর্কতার সাথে করতে হবে। কারণ হাঁচি কাশির মাধ্যমে শিশুরা এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। হাঁচি দেয়ার সময় নাকে মুখে রুমাল অথবা টিস্যু পেপার ব্যবহার করতে হবে। যেখানে সেখানে থুথু বা নাকের পানি বা শ্লেষ্মা ফেলা যাবে না। নিজের ব্যবহৃত রুমাল, গামছা বা কাপড় অন্যকে ব্যবহার করতে দেয়া যাবে না। ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে হবে। হালকা গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করতে হবে। দারুচিনি, লেবু, এলাচ দিয়ে লাল চা পান করতে পারেন।
ঘাঁপানি: অ্যাজমাজাতীয় শ্বাসকষ্টের রোগ। এ রোগটি শুধু শীতকালের নয় সারা বছরের। তবে শীতের মৌসুমে তা বেড়ে যায়। তাই তীব্র শীত আসার আগেই সতর্কতা ও সচেতনতা খুবই প্রয়োজন। রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় এবং কষ্টের পরিমাণও কমে আসে। কারণ: যেসব খাবার খেলে অ্যালার্জি হয় যেমন: চিংড়ি, গরুর গোশত, ইলিশ মাছ ইত্যাদি, বায়ুর সাথে ধোঁয়া, ধুলাবালি, ফুলের রেণু ইত্যাদি শ্বাস গ্রহণের সময় ফুসফুসে প্রবেশ করলে হাঁপানি হতে পারে। বংশগত কারণেও হাঁপানি হতে পারে। শিশুদের সর্দি কাশি থেকেও হাঁপানির সৃষ্টি হতে পারে।
লক্ষণ: হঠাৎ শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। শ্বাসকষ্টে দম বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়। ঠোঁট নীল হয়ে যায় ও গলার শিরা ফুলে যায়। রোগী জোরে জোরে শ্বাস নেয়। বুকের ভেতর সাঁই সাঁই শব্দ হয়। কাশির সাথে সাদা কফ বের হয়। শ্বাস নেয়ার সময় রোগীর পাঁজরের মাঝে চামড়া ভেতরের দিকে ঢুকে যায়। রাতে রোগীর শ্বাস নিতে কষ্ট হয় বলে বিছানা ছেড়ে বসে থাকে।
করণীয়: যেসব খাবারে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায় তা পরিহার করতে হবে। শরীরে ঠাণ্ডা লাগানো যাবে না। ঘরে পর্যাপ্ত পরিমাণে আলো বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা করতে হবে। যেসব সংস্পর্শে হাঁপানি বেড়ে যায় তা থেকে বিরত থাকতে হবে, যেমন : পশুর লোম, কৃত্রিম আঁশ, ধূমপান, গুল, সাদা পাতা, জর্দার ব্যবহার পুরোপুরি বাদ দিতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শে চলতে হবে।
নিউমোনিয়া: একটি ফুসফুসের রোগ। অতিরিক্ত ঠাণ্ডা লাগার কারণে নিউমোনিয়া হতে পারে। শিশু ও বয়স্কদের জন্য এটি একটি মারাত্মক রোগ। পৃথিবীব্যাপী ৫ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ হলো নিউমোনিয়া। আমাদের বাংলাদেশেও শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ নিউমোনিয়া। অভিভাবকদের সতর্কতা ও সচেতনতার ফলে এ রোগ থেকে অনেকাংশে বেঁচে থাকা যায়। এ রোগ প্রতিরোধযোগ্য এবং সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময়যোগ্য।
কারণ: নিউমোকক্কাস নামক ব্যাকটেরিয়া রোগের অন্যতম কারণ। তাছাড়া আরো বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ছত্রাকের আক্রমণে নিউমোনিয়া হতে পারে।
লক্ষণ: ফুসফুসে শ্লেষ্মাজাতীয় তরল পদার্থ জমে কফ সৃষ্টি হয়। কাশি এবং শ্বাসকষ্ট হয়। বেশি জ্বর হয়। বেশি আক্রান্ত হলে বুকের মধ্যে গড় গড় শব্দ হয়।
করণীয়: ঠাণ্ডা লাগানো যাবে না। শীত উপযোগী হালকা ও নরম গরম কাপড় ব্যবহার করতে হবে। ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করানো যাবে না। সহনীয় গরম পানিতে গোসল দিতে হবে। সর্দি কাশি হাঁচিতে আক্রান্ত শিশুরা বা লোকদের কাছে শিশুকে নেয়া যাবে না। হাঁচির মাধ্যমে নানা রোগ ছড়াতে পারে। ধুলাবালু, চুলার ধোঁয়া, মশার কয়েল ও সিগারেটের ধোঁয়া থেকে অবশ্যই শিশুদের দূরে রাখতে হবে। তরল ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে হবে।
চর্মরোগ: শীতকালে আবহাওয়ার সাথে কম তাপমাত্রার সংযোগ আর ধুলাবালু সব মিলিয়ে স্বাস্থ্যের নানা সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে একটি হলো চর্মরোগ। শীতকালে এর প্রকোপ বেড়ে যায়। শীতের সময় বাতাসের জলীয়বাষ্প কমে যাওয়ার কারণে চামড়া থেকে পানি চুষে নেয়। এর ফলে ত্বক বা চামড়া শুষ্ক হয়ে ওঠে এ সমস্যাটি কম বেশি সব বয়সের নারী-পুরুষের হয়ে থাকে। বিশেষ করে পা, পেটে উভয় দিক এবং ঠোঁট বেশি আক্রান্ত হয়। পায়ে ধুলাবালি লেগে থাকলে পা ফেটে যেতে পারে।
করণীয়: যাদের এমন সমস্যা দেখা দেয় তারা অল্প গরম পানিতে কম সময় গোসল করুন। যতটা সম্ভব কম ক্ষারযুক্ত সাবান ব্যবহার করুন। গোসলের পর শরীরে ময়েশ্চারাইজার যেমন: পেট্রোলিয়াম জেলি, গ্লিসারিন, বিভিন্ন লোশন ব্যবহার করুন। শীত মৌসুমে খাঁটি অলিভ অয়েল সারা শরীরে ব্যবহার করুন। এতে শরীরের চামড়া ফাটবেও না মসৃণও হবে এবং শীতও কম লাগবে। হাত পা ও ঠোঁটে পেট্রোলিয়াম জেলি ব্যবহার করুন। ত্বককে সুরক্ষা রাখতে ভ্যাসলিন, গ্লিসারিন, অলিভ অয়েল, সরিষার তেল ব্যবহার করুন। বেশিক্ষণ রোদে থাকবেন না। কড়া আগুন পোহাবেন না। এতে চামড়ার সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
ব্যথাবেদনা: দেশে বেশির ভাগ পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তিরাই শরীরের নানা বিষ বেদনায় ভোগেন। এ দেশে ৫০ ঊর্ধ্ব জনসংখ্যার শতকরা ৬৫ ভাগই ব্যথাজনিত সমস্যায় ভোগেন। বিশেষ করে যেসব জয়েন্ট শরীরের ওজন বহন করে এবং বেশি ব্যবহৃত হয় সেগুলো ব্যথা-বেদনা বেশি হয়। ঘাড়, কোমর, সোল্ডার জয়েন্ট, হাঁটুর ব্যথা, পায়ের ব্যথা ও মেরুদণ্ডের ব্যথা উল্লেখযোগ্য। শীরের নানা অংশে সমস্যার কারণ মেরুদণ্ডের মাংসপেশি বা কশেরুকার সমস্যা, লিগামেন্ট মসকানো, দুই কশেরুকার মধ্যবর্তী ডিস্ক ক্ষয় হয়ে যাওয়া বা সমস্যা। আর বয়সজনিত হাড় ও জোড়ার ক্ষয়।
করণীয়: ব্যথাবেদনা বেশি হলে কমপক্ষে ৭ দিন বিশ্রামে থাকুন। ব্যথার জায়গা ১০-১৫ মিনিট গরম বা ঠাণ্ডা সেঁক দিন। বিছানায় ঘুমাবার সময় যেকোনো একদিকে কাত হয়ে হাতের উপর ভর দিয়ে শোয়া ও ওঠার চর্চা করুন। ঘাড় নিচু করে কোনো কাজ করবেন না। পিঁড়ি, মোড়া বা ফ্লোরে না বসে চেয়াে র মেরুদণ্ড সোজা করে বসুন। শক্ত সমান বিছানায় ঘুমাবেন। মাথায় বা হাতে ভারী বোঝা বহন করবেন না। শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ রাখুন। দাঁড়ানো থেকে হঠাৎ করে নিচু ভারী জিনিস ধরবেন না বা তুলবেন না। যেকোনো সমস্যা দেখা দিলে অভিজ্ঞ চিকিৎসক’র পরামর্শ নিবেন।
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক স্বাস্থ্য তথ্য
স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা, হিউম্যান রাইটস রিভিউ সোসাইটি
কো-চেয়ারম্যান, হোমিওবিজ্ঞান গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
মোবাইল নং: ০১৮২-২৮৬৯৩৮৯