আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
পৃথিবী থেকে ১৩০০ আলোকবর্ষ দূরের অরিয়ন বা কালপুরুষ নীহারিকার একটি গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ হলো জিডব্লিউ অরি। ধুলো এবং গ্যাসের বিশাল এক বলয় ঘিরে রয়েছে একে। সদ্য সৃষ্টি হওয়া ছায়াপথে, যেখানে গ্রহ তৈরির প্রক্রিয়া চলমান, সেখানে সাধারণত এ ধরনের বলয় তৈরি হয়। অদ্ভূত বিষয় হলো এই যে গ্রহ তৈরির প্রক্রিয়া সেখানে চলছে, সেটা কোনো একটা নক্ষত্র কেন্দ্র করে নয়, বরং তিনটা নক্ষত্র কেন্দ্র করে চলছে এ প্রক্রিয়া।
এখানেই শেষ নয়। আরও অবাক করা বিষয় হলো জিডব্লিউ অরির এই বলয় দু’ভাবে বিভক্ত। শনির বলয়ের কোনো অংশে যদি বড় একটা ফাঁক থাকতো তাহলে সেটা দেখতে যেমন হতো, এটাও দেখতে ঠিক তেমন। সেখানকার পরিস্থিতি আরও উদ্ভট হয়েছে বলয়ের বাইরের দিককার অংশটার জন্য। এ অংশটা ৩৮ ডিগ্রি কাত হয়ে আছে।
ওখানে যে আসলে কী হচ্ছে বিজ্ঞানীরা তা বোঝার চেষ্টা করছেন। কারও কারও অনুমান যে, সেখানে হয়তো এক বা একাধিক গ্রহ তৈরির একটা প্রক্রিয়া চলছে। আর সেটার কারণেই হয়তো বলয়ের মাঝে ফাঁকটা তৈরি হয়েছে। এমনটা যদি হয়, তবে এ গ্রহই হবে এখনও পর্যন্ত সন্ধান পাওয়া প্রথম গ্রহ যেটা একসাথে তিনটি নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। ইংরেজিতে এ ধরনের গ্রহকে বলা হচ্ছে ‘সারকামট্রিপল প্ল্যানেট।’
বিজ্ঞানীরা জিডব্লিউ অরির একটা বিশদ মডেল তৈরি করেছেন। আর তার বলয়ে যে ফাঁকা অংশ রয়েছে তার সম্ভাব্য কারণ ব্যাখ্যায় তারা বৃহস্পতির মতো বিশাল কোনো গ্যাসীয় গ্রহের তৈরির বিষয়টিকেই সবার ওপরে রাখছেন। এ গ্রহটিকে এখনও যদিও দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু এর জন্মপ্রক্রিয়ার এই প্রথম ১০ লাখ বছরে তার কক্ষপথ কেমন হবে তার একটা ধারণা বিজ্ঞানীরা পাচ্ছেন।
রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনোমিক্যাল সোসাইটির মাসিক নোটিশে এ বিষয়টির কথা বলা হয়েছে। এতে বিজ্ঞানীরা বলয়ের মাঝের ফাঁকা অংশের জন্য অন্য কোনো সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। অন্য কারণগুলোর মধ্যে একটিতে বলা হচ্ছে- সেখানকার নক্ষত্রগুলোর নিজস্ব মধ্যাকর্ষণ শক্তিই বলয়ের ওই ফাঁকা অংশ তৈরি করেছে। তবে এ ব্যাখ্যা যারা উড়িয়ে দিচ্ছেন তারা বলছেন, মধ্যাকর্ষণ শক্তির ওই ব্যাপারটা থাকলে বলয়ে আরও অনেক বেশি অস্থিরতা থাকতো। যেহেতু সেটা নেই তাই ওই ব্যাখ্যার জন্য পর্যাপ্ত গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া যায় না।
এ থেকে আরও একটা বিষয়ে বিজ্ঞানীরা ধারণা পেয়েছেন যে, আসলে গ্রহের জন্মপ্রক্রিয়ার আরও কত পদ্ধতি থাকতে পারে, যেগুলো সম্পর্কে এখনও কোনো ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না।
১৯৭৭ সালে মুক্তি পাওয়া জর্জ লুকাস পরিচালিত স্টার ওয়ার্স সিরিজের চলচ্চিত্রগুলো যারা দেখেছেন তাদের এমন গ্রহ সম্পর্কে ধারণা আছে যার আকাশে একদিকে একটি নক্ষত্র উদয় হয়, আরেকদিকে আরেকটি নক্ষত্র অস্ত যায়। ওই সিরিজে লুক স্কাইওয়াকারের বাস যে গ্রহে, ট্যাটুইন হলো সেরকম দুই নক্ষত্রের একটি গ্রহ। কিন্তু একটি গ্রহ একসাথে তিনটি নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরছে, সেটা এখনও পর্যন্ত অস্বাভাবিক একটা ব্যাপারই হয়ে আছে।
তবে কল্পনার খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায় যে গ্যাসীয় ওই গ্রহে মানুষ পৌঁছাতে পেরেছে বা মানুষ সেখানে টিকে থাকতে পারছে, সে কিন্তু এক আকাশে তিন সূর্য (নক্ষত্র) দেখতে পাবে না। সে দেখবে দুই সূর্য। কারণ, তিন নক্ষত্রের যে দুটি গ্রহটির কাছে সে দুটির অবস্থান এত কাছাকাছি যে দূর থেকে তা দেখে মনে হবে একটি আলোর বিন্দু বা উৎস। তবে এই গ্রহ যখন তার নিজ অক্ষে একবার পাক খাবে তখন ওই নক্ষত্রগুলো উদয় আর অস্তের যে দৃশ্য সেখান থেকে দেখা যাবে, অদ্ভূত সেই দৃশ্য আর কোনো বিশ্ব থেকে দেখা যাবে না।
আসলে নটি নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরছে- এমন গ্রহের খোঁজে বহুদিন ধরেই ছিলেন বিজ্ঞানীরা। পৃথিবী থেকে ৪৫০ আলোকবর্ষ দূরে জিজি টাউ এ ছায়াপথে এমন একটি গ্রহ পাওয়ার বিষয়ে বেশ আশাবাদীও ছিলেন তারা। কিন্তু এই জিডব্লিউ অরিতে গ্যাস এবং ধূলার যে বলয় রয়েছে তা থেকে বিজ্ঞানীদের মনে নতুন করে আশা জন্মেছে যে এখানেই হয়তো তাদের কাঙ্ক্ষিত সেই ত্রিনক্ষত্রের গ্রহ রয়েছে।
এ নিয়ে গবেষণা কাজে নেতৃত্ব দেওয়া ইউনিভার্সিট অব নেভাদার জেরেমি স্মলউড বলছেন, এটাই হয়তো এ ধরনের কোনো গ্রহের প্রথম প্রমাণ।
একই রকম আশার কথা বলছেন স্যান ডিয়েগো স্টেট ইউনিভার্সিটির জ্যোতির্বিজ্ঞানী উইলিয়াম ওয়েলশ। তিনি বলছেন, সত্যিই যদি সেখানে কোনো গ্রহ থেকে থাকে, সেটা দারুণ এক ব্যাপার হবে।
তবে এই গ্রহের মতবাদের সাথে একমত নন যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লিয়েসেস্টারের অ্যালিসন ইয়াং। তার মতে সেখানকার নক্ষত্রের মধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণেই বলয়ে ওই ফাঁকা অংশ তৈরি হয়েছে। তিনি বলছেন, এএলএমএ টেলিস্কোপ ও চিলির ভেরি লার্জ টেলিস্কোপ ফ্যাসিলিটি থেকে পর্যবেক্ষণ এ বিতর্কের অবসান ঘটাবে।
তিনি বলছেন, ওই বলয়ে কোনো গ্রহ আছে কি না তার সরাসরি একটা প্রমাণও আমরা পাবো।
গ্রহের এই তত্ত্ব যদি সঠিক হয় তবে গ্রহ সৃষ্টির প্রচলিত ধারণাই বদলে যাবে। দুটি নক্ষত্রে কেন্দ্র করে ঘুরছে, এমন বেশ কিছু গ্রহের খোঁজ ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে। ইংরেজিতে এগুলোকে ‘সারকামবাইনারি প্ল্যানেট’ বলা হয়। কিন্তু তিনটি নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরছে এমন গ্রহ বিরলই।
সূত্র : দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস।