করোনাভাইরাসের সংক্রমণে দেশে আবারও মৃত্যু বাড়ছে। এর চেয়েও আশঙ্কার কথা হচ্ছে, প্রায় দেড় বছরের মধ্যে এখনই মৃত্যু দ্রুত বাড়ছে এবং ঢাকার বাইরে মৃত্যু বৃদ্ধির হারও বেশি। বিশেষ করে খুলনা ও রাজশাহী অঞ্চলের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে ১৩৫ শতাংশ মৃত্যু বেড়েছে খুলনা বিভাগে। একই সময়ে রাজশাহী বিভাগে মৃত্যু বৃদ্ধির হার ৬৭ শতাংশ, যা ঢাকা বা চট্টগ্রামের তুলনায় অনেক বেশি।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, ঢাকা বা চট্টগ্রামের তুলনায় দেশের অন্যান্য বিভাগে স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা পর্যাপ্ত নয়। করোনায় আক্রান্ত রোগীর অবস্থা জটিল হলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার সক্ষমতা জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে কতটা রয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এমনিতেই বেশি সংক্রমিত জেলাগুলোর হাসপাতালে রোগীর চাপ সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে, সেখানে জটিল উপসর্গের রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার মতো জনবল এবং কারিগরি সক্ষমতাও অনেকটা সীমিত। ফলে ঢাকার বাইরে যেভাবে নতুন রোগী বাড়ছে, তাতে সামনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপিত খুলনা করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়ছেই। ১৩০ শয্যার এই হাসপাতালে এখন প্রতিদিন রোগী ভর্তি থাকছেন ১৫০ জনের বেশি। গতকাল রোববার এই হাসপাতালে রোগী ভর্তি ছিলেন ১৫৯ জন। ধারণক্ষমতার চেয়েও এত বেশি রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা।
খুলনার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, একজন–দুজন সচেতন থেকে লাভ নেই। অন্যদেরও সচেতন থাকতে হবে। জেলা প্রশাসন থেকে যে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তার কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। এমন থাকলে নামে নামে লকডাউন দিয়ে কোনো কাজ হবে না।
জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারাও মনে করেন, স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণেই খুলনায় করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। বারবার সতর্ক করে বিধিনিষেধ আরোপ করা হলেও মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়েনি।
খুলনার সিভিল সার্জন নিয়াজ মোহাম্মদ বলেন, সাধারণ মানুষ যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন, সে জন্য প্রচার-প্রচারণার পাশাপাশি জরিমানাও করা হচ্ছে। তারপরও সচেতনতা আসেনি। এ কারণে মঙ্গলবার থেকে খুলনা মহানগর ও জেলায় কঠোর লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে।
গত বছর দেশে সংক্রমণের ‘পিক’ (চূড়ায় ওঠা) ছিল মে মাস থেকে আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। করোনার ‘প্রথম ঢেউয়ের’ ওই সময়ে এক দিনে সর্বোচ্চ রোগী শনাক্ত হয়েছিল ৪ হাজার ১৯ জন। আর সর্বোচ্চ মৃত্যু ছিল ৬৪। কিন্তু এবার দ্রুততম সময়ে বেশিসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হতে পারে, এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, সাধারণত করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে শুরু করার তৃতীয় সপ্তাহ থেকে মৃত্যুও আনুপাতিক হারে বাড়তে থাকে। চলতি বছরের মার্চ ও এপ্রিল মাসে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় দেখা গেছে, দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা তিন হাজার ছাড়ানোর সপ্তাহ দেড়েক পর থেকে দৈনিক মৃত্যু ৫০ ছাড়ায়। দৈনিক শনাক্ত ছয় হাজার ছাড়ানোর দুই সপ্তাহ পর থেকে মৃত্যু ৯০-এর ওপরে উঠেছিল। এর মধ্যে পাঁচ দিন মৃত্যু ছিল শতাধিক। কিন্তু এবার দৈনিক শনাক্ত দুই হাজার ছাড়ানোর এক সপ্তাহের মাথায় মৃত্যু ৫০ ছাড়াতে দেখা গেছে। এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন ৫০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। দুই দিন ধরে দৈনিক মৃত্যু ৬৫-এর ওপরে। এর মধ্যে গতকাল ৮২ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, যা গত ৫৩ দিনের মধ্যে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চসংখ্যক মৃত্যুর রেকর্ড।
সাত দিন ধরে দৈনিক শনাক্ত গড়ে তিন হাজার ছাড়িয়েছে। সে হিসাবে আগামী কিছুদিনের মধ্যে দৈনিক মৃত্যু আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
দেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ মার্চ। চলতি বছরের মার্চ থেকে দেশে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে গত ৫ এপ্রিল থেকে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করে সরকার। এখনো কিছু বিধিনিষেধ জারি আছে। লকডাউনের প্রভাবে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে সংক্রমণ কমতে শুরু করেছিল। পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে সংক্রমণে আবার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা তৈরি হয়।
গত ৩১ মে পর্যন্ত দেশে করোনায় মোট মৃত্যুর ৫৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ ছিল ঢাকা বিভাগে। চট্টগ্রামে ছিল ১৯ দশমিক ০৯ শতাংশ। অন্যদিকে রাজশাহীতে ছিল ৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ, খুলনার ৬ দশমিক ২৪ শতাংশ। তবে গত ২০ দিনে পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এখন মোট মৃত্যুর ৭ দশমিক ২৯ শতাংশ হয়েছে খুলনায়। রাজশাহীতে হয়েছে ৬ দশমিক ৪১ শতাংশ।
এক সপ্তাহের ব্যবধানে মৃত্যু বৃদ্ধির হারও বেশি খুলনা ও রাজশাহীতে। ৭ জুন থেকে ১৩ জুন—এই এক সপ্তাহের তুলনায় ১৪ থেকে ২০ জুন—এই এক সপ্তাহে খুলনায় মৃত্যু বেড়েছে ১২৯ শতাংশ। রাজশাহীতে বেড়েছে ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এই বৃদ্ধির হার ঢাকায় ২৯ এবং চট্টগ্রামে ২১ শতাংশ। গত এক সপ্তাহে মোট মৃত্যুর এক–চতুর্থাংশ হয়েছে খুলনায়। আর গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ৮২ জনের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩২ জন ছিলেন খুলনা বিভাগের বাসিন্দা।
খুলনা বিভাগের ১০ জেলার মধ্যে খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, চুয়াডাঙা, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা ও নড়াইলে সংক্রমণ বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, খুলনা বিভাগে কোভিড–১৯ চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত সাধারণ শয্যা ৭৩৮টি। আইসিইউ আছে ৪০টি, হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলাসহ আইসিইউ সমমানের শয্যা আছে ৩০২টি। আর অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটরসহ এইচডিইউ সমতুল্য শয্যা আছে ১৭৫টি। কিন্তু এই বিভাগে যেভাবে সংক্রমণ ও জটিল রোগী বাড়ছে, তাতে এই সুবিধা যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা।
খুলনার মতো একই অবস্থা রাজশাহীর। শহরের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ১১ জুন বিকেল থেকে সেখানে লকডাউন দেওয়া হয়। গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রথম সাত দিনের লকডাউন শেষ হয়। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় লকডাউন আরও সাত দিন বৃদ্ধি করা হয়। গতকাল ছিল লকডাউনের দশম দিন।
রাজশাহী সিভিল সার্জন দপ্তরের পাঠানো প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজশাহীতে গতকাল শনাক্তের হার ২৫ দশমিক ১২ শতাংশ। এটি এখন পর্যন্ত এই জেলায় এক দিনে সর্বোচ্চ শনাক্ত। তবে সংক্রমণ বাড়লেও লকডাউনে মানুষের চলাচল কমেনি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রেও উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে।
রাজশাহী শহরের একটি বিশাল এলাকার দায়িত্বে রয়েছে বোয়ালিয়া মডেল থানা। এই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিবারণ চন্দ্র বর্মন বলেন, পুলিশকে লকডাউন বাস্তবায়নের পাশাপাশি অপরাধী ধরা, কোর্টে রিপোর্ট করাসহ নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। তখন কিছু এলাকায় পুলিশ টহলে না থাকলে ওই এলাকার মানুষ বের হয়ে আসে। অটোরিকশাগুলোও বের হয়ে আসে। তিনি বলেন, পুলিশ কয়জনকে ঘরের ভেতরে রাখবে। করোনা পরিস্থিতি খারাপ, তাই সবাইকে সচেতন হতে হবে।
এদিকে গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আরও ৮২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময়ে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৩ হাজার ৬৪১ জনের। দেশে এ পর্যন্ত করোনা সংক্রমিত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মোট ৮ লাখ ৫১ হাজার ৬৬৮। মোট মৃত্যু হয়েছে ১৩ হাজার ৫৪৮ জনের। সুস্থ হয়েছেন ৭ লাখ ৮২ হাজার ৬৫৫ জন।
জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ঢাকার বাইরে স্বাস্থ্যসেবা–সুবিধা অপ্রতুল। এখন সুবিধা আর খুব বেশি বাড়ানোর সুযোগও হয়তো কম। সংক্রমণ যত বাড়বে, মৃত্যুও তত বাড়বে। এই অপ্রতুল সুবিধা নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখন রোগী ব্যবস্থাপনা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।