ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
কুরবানির ঈদ এলে সুস্বাদু ও ভারি খাবার খাওয়ার পরিমাণ যেমন বাড়ে তেমনি বিশেষত এই ঈদেই অনেক বেশি স্বাস্থ্যসচেতন থাকতে হয়।প্রতিবারই এমন সব জমজমাট পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করেই ধর্মীয় উৎসব থেকে জাতীয় দিবস এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকেও সম্প্রসারিত করে গণমানুষের আনন্দ আয়োজন উদযাপন করা হয়। তবে ফেলে আসা দিনগুলো আর আজকের পরিবেশ পরিস্থিতি একেবারেই আলাদা। সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতায় এসেছে এক ধরনের বিপন্ন অবস্থা যা কোন উৎসব আয়োজনকে আমলে নিতেও প্রাচীর সম ব্যবধান তৈরি করেছে। করোনা মহামারীর মহাবিপর্যয়ে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব এক দুঃসহ সময় পার করছে। মানুষের মিলনযজ্ঞে সমাজ সভ্যতার সংহতি আড়ম্বর আর আনন্দযোগের নিয়ামক শক্তিও আজ বিপর্যস্ত, দিশেহারা। কোভিড-১৯ নামে পরিচিত এই বহুল সংক্রমণটি ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাস থেকেই তার অশুভ বার্তা জানান দিলে সর্বপ্রথম বৃহত্তর এশিয়ার চীনেই তার কালো ছায়া পড়ে। হুবেই প্রদেশের উহান শহরে উদ্ভূত এই ভাইরাসটি তার সংক্রমণের ব্যাপকতায় আক্রান্ত অঞ্চলটি ছাড়া চীনের অন্য কোথাও তার কোন নিশানা পাওয়া যায়নি। সে সময় চীন অত্যন্ত দক্ষতা এবং বিচক্ষণতার সঙ্গে সংক্রমণটি নিয়ন্ত্রণে আনতে উহানকে অন্যান্য এলাকা থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। অবরুদ্ধতার কঠিন জালে উহান আটকে পড়লে ভাইরাসটিও সেখানেই তার বহুল সংক্রমণটি ছড়িয়ে দেয়। ধারণা করা হয়েছিল উহানের কোন এক গবেষণাগার থেকে এই ভাইরাসটির উৎপত্তি। তেমন বিতর্কের এখন অবধি কোন সুরাহা হয়নি।
আবার এমন অভিমতও উঠে আসে মানুষের খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে ভাইরাসটির কোন যোগাযোগ থাকতে পারে। যেমন- বনরুই, বাদুড় কিংবা অন্য কোন বন্যপ্রাণী থেকে ভাইরাসটি আসতে পারে। তেমন বিবেচনায় উৎপত্তিটি প্রাকৃতিক এবং বহুল সংক্রমণও। তবে করোনা এশিয়া কিংবা দক্ষিণ এশিয়ায় তার কালো ছায়া না ফেলে লাফ দিয়ে চলে যায় আমেরিকা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। ভয়ানকভাবে আক্রান্ত কোন দেশই এখন পর্যন্ত সেভাবে রোগটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। কমার পরও নতুন ভাবে সংক্রমণের আশঙ্কা সারা বিশ্বকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ফেলে দিয়েছে। এখনও প্রতিদিন দুই লাখের বেশি বিশ্ববাসী এই রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুর সংখ্যাও কম নয়,বাংলাদেশ এই নতুন সংক্রমণটিকে প্রথম উপলব্ধি করে মার্চ মাস থেকে। যখন বহুল সংক্রমিত দেশ ইতালি থেকে প্রবাসী বাঙালীরা দেশে ফিরতে শুরু করে। চীনের উহান থেকে যখন বাঙালীরা দেশে ফিরল তাদের কোয়ারেন্টাইনে রেখে স্বাস্থ্যবিধির আওতায় আনা হয়। সে অবধি চীন থেকে স্বদেশে আসা বাঙালীরা অত্যন্ত সচেতনভাবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা আমলে নিলে সংক্রমণটি বাংলাদেশকে আক্রান্ত করতে পারেনি। বিপন্নতার শিকার শুরু হলো যখন ইতালি থেকে ভয়ে-আতঙ্কে প্রবাসীরা দেশে ফিরে কোন স্বাস্থ্যবিধিকে তোয়াক্কা না করার চরম গাফিলতি দেখাল। স্বাস্থ্যবিধি তো মানলই না বরং দেশের বিভিন্ন জেলা- উপজেলায় নিজেদের বাড়িতেও ছড়িয়ে পড়ল। আমরা যদি একটু সচেতন হয়ে সে সময় স্বাস্থ্যবিধির সমস্ত নিয়মকানুনকে বিবেচনায় রাখতে পারতাম তাহলে আমাদের বর্তমান দুঃসময়কে মোকাবেলা করতে হতো না। শুধু তাই নয় স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিবিধ পর্যায়ে এখন অবধি অবহেলা এবং উপেক্ষার চিত্রই সব সময় উঠে আসছে। ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং ২৬ মার্চ শুরু হয়ে যায় সাধারণ ছুটির ঘোষণা সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু মানুষের মধ্যে তেমন সংক্রমণকে খুব বেশি নাড়া দিতেও পারেনি। মানুষের অভিজ্ঞতায় তেমন অবরুদ্ধতার কঠিন বেড়াজাল সে অবধি এক প্রকার অনুপস্থিতই বলা যায়। ফলে লকডাউনের গুরুত্ব এবং প্রাসঙ্গিতাকে সাধারণ মানুষ আমলে নিতেও ব্যর্থ হয়। সামাজিক দূরত্বকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টি এখন পর্যন্ত জনগণকে মানানো যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ, স্বাধীনতা দিবস এবং বৈশাখী উৎসবকেও সীমিত আকারে ঘরে পালিত হয়েছে। আর করোনা মহামারী বৃদ্ধির কারণে জুলাই ২০২১ ইং ১ম টানা দুই সপ্তাহের কঠোর লকডাউনের পর ১৫ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত সরকার লকডাউন শিথিল করেছে।বাস-ট্রেন-লঞ্চ-নৌযান চলার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
২১ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য কোরবানির ঈদে গ্রামমুখী মানুষ যেন নিরাপদে যেতে পারেন, ব্যবসা বাণিজ্য যাতে কিছুটা সচল হয়- সেজন্যই ঈদের আগের ছয়দিন দূরপাল্লার যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত করছে সরকার। আবার ঈদ শেষে ঢাকামুখীদের জন্য আরও একদিন অর্থাৎ ২২ জুলাই হাতে রাখা হয়েছে। এ কয়দিন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলার অনুমতি রয়েছে। খুলে দেওয়া হয়েছে সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালত। তারপরে আবার ২৩ জুলাই থেকে ৫ অগাস্ট পর্যন্ত চলবে কঠোর লকডাউন ব্যবস্থা।অংকটি অতি সরল অংক। কিন্তু ফলাফল অনেক জটিল। সরকারকে এমন সময়ে এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে হলো, যখন সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এর সংক্রমণ। দেশে দৈনিক সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। শুধু ছাড়িয়েই যায়নি, নতুন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে। দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা এখন ১২/১৩ হাজারের মধ্যে ওঠানামা করছে, যা এর আগে ছিল না। এবং মৃত্যু! সে তো ২০০ নিচে নামতেই চাচ্ছেনা না।পাশাপাশি অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না।
মানুষ এবারও স্বাস্থ্যবিধিকে তোয়াক্কা করে দেশের বাড়িতে যাবে না। এখানে শুধু বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় যাতায়াতই নয় আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পশুর হাট বসার এক সামাজিক নিয়ম যা কোনভাবেই স্বাস্থ্যবিধির আওতায় পড়ে না। তবে এ ব্যাপারে খামারিদের বাণিজ্যিক বিষয়টিও ভাবার অবকাশ রাখে। সারা বছর পশুপালন প্রক্রিয়ায় গরু, ছাগল, ভেড়া ব্যবসায়ীরা লালন পালন করতে থাকে কোরবানির বড় বাজারকে উপলক্ষ করেই। পশুর হাট সীমিত আকারে বসার নির্দেশ দিয়েছে সরকার স্বাস্থ্যবিধি আর সামাজিক দূরত্বকে বিবেচনায় রেখে। কিন্তু এমন বিবেচনাবোধ আগেও পরিলক্ষিত হয়নি।এই পবিত্র দিনে, মানুষ ঈদের জামাতে অংশ নিতে মসজিদগুলোতে বা খোলা জায়গায় জড়ো হয়।দাতব্য কাজ করে, ভোজের আয়োজন করে এবং একে অপরের বাড়িতে বেড়ানোর মাধ্যমে এই দিনটিকে উদযাপন করা হয়। আজ দুই বছর ঈদ উদযাপন আলাদা হবেএই মুহূর্তে, বিশ্ব একটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং এবং কঠিন সময় পার করছে। করোনাভাইরাস মহামারী মানব জাতিকে কেবল স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখোমুখি করেছে তা নয়, বহু অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে। সামাজিক দূরত্ব এবং লকডাউন নিয়মাবলী অনুসরণ করা এই হুমকি মোকাবেলার একমাত্র সম্ভাব্য সমাধান বলে মনে হয়। এই পরিস্থিতিতে, বিপুল সংখ্যক লোক (বন্ধুবান্ধব এবং পরিবার) সহ ঈদ বা যেকোনো ধরণের উদযাপন আমাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখোমুখি করবে, তাই না?ঈদ উদযাপন জন্য গাইডলাইন পরিস্থিতির গুরুতরতার কথা মাথায় রেখে অনেক ধর্মীয় সংস্থা এবং সম্প্রদায়ের নেতারা জনসমাগম এড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। সেক্ষেত্রে, আপনি ভাবছেন যে কীভাবে আপনি লকডাউনের সময় আপনার পরিবারের সাথে নিরাপদে ঈদ উদযাপন করতে পারেন, জেনে নিন-ভার্চুয়াল পার্টির আয়োজন রনারকম সুস্বাদু খাবার ঈদ উদযাপনের একটি বড় অংশ। ভোজের জন্য প্রস্তুতি প্রায় একদিন আগে থেকেই শুরু হয় এবং পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুবান্ধবদের জন্য বিভিন্ন ধরণের খাবার থেকে রান্না করা হয়। ঈদের সন্ধ্যায় একে অপরের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া এবং পার্টির আয়োজন করে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় মানুষের সামাজিক পরিদর্শন এড়ানো উচিত এবং গত বছরের মতো পরিবর্তে ভার্চুয়াল পার্টির আয়োজন করা যেতে পারে। তারা বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সংযুক্ত হতে পারে এবং একই সময়ে তাদের বন্ধু এবং পরিবারের সদস্যদের মতো নিজের জায়গায় থেকে উৎসবে সামিল হতে পারে। বাড়ির সাজসজ্জা উৎসব পালনের অন্যতম অঙ্গ হলো বাড়ির সাজসজ্জা।
আপনি আপনার বাড়িকে থিম অনুসারে সাজাতে পারেন। এটি আপনাকে কেবল ব্যস্তই রাখবে না, সবাইকে উৎসবের প্রতি আগ্রহী করবে এবং আশা করি তারা তাদের বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনের অভাব কিছুটা কম বোধ করবে।অনলাইনে দান করুন গরিব ও অভাবী লোকদের সঙ্গে বাইরে গিয়ে দেখা করার পরিবর্তে অনলাইন দাতব্য বা অনুদান বেছে নেয়া উচিত। এই দিনগুলোতে প্রচুর লোকের সাহায্যের প্রয়োজন রয়েছে এবং অনেক সংস্থা (বেসরকারী এবং সরকারি উভয়ই) এই ধরনের লোকদের ত্রাণ তহবিল দিচ্ছে এবং যখনই প্রয়োজন তাদের সহায়তা করছে। আপনি এই সংস্থাগুলোর মাধ্যমে অনলাইনে অনুদান করতে পারেন।সুন্দর পোশাক পরুন যেহেতু বাড়িতেই থাকছেন তাই নতুন পোশাক কিংবা সাজগোজের দিকে হয়তো মনোযোগ থাকবে না। কিন্তু কোনো উৎসবই সুন্দর পোশাক ও সাজসজ্জা ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। নতুন পোশাক নেই তো কী হয়েছে, আগের বছরের পোশাক থেকেই একটি সুন্দর পোশাক বাছাই করুন। কাপড়ে সুগন্ধি আতর ছড়িয়ে দিন। এটি উৎসবের আমেজ বাড়িয়ে তুলবে।যাই হোক না কেন, সামাজিক দূরত্ব অনুসরণ করুন নিজেকে লোকেদের থেকে দূরে রাখার সর্বোত্তম চেষ্টার পরেও যদি কেউ আপনাকে বেড়াতে চলে আসে তবে অতিথিকে স্বাগত জানাতে গিয়ে কমপক্ষে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করা উচিত। আলিঙ্গন বা হ্যান্ডশেক এড়িয়ে চলুন, একটি মাস্ক পরুন এবং আলাপচারিতার সময় কমপক্ষে এক মিটার দূরত্বে থাকুন। স্যানিটাইজ করতে ভুলবেন না।
কোরবানির ঈদও সে মাত্রায় আমাদের যথাসম্ভব সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে সর্বাদিক গুরুত্ব দিতে হবে। যদি সম্ভব হয় এবার দেশের বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারটাও ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ঈদের দিন সকালের খাবারঃ- ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে অল্প করে সেমাই বা পায়েশ খান। অনেকেই শরবত, কোমল পানীয়, ফ্রুট জুস ইত্যাদি খাওয়া পছন্দ করেন। চেষ্টা করুন মৌসুমি ফল দিয়ে এসব জুস তৈরি করতে। কারণ এসব জুসের কোনো তুলনা নেই। তাতে মজা ও উপকার দুই-ই পাবেন। লেবুর শরবত, বাসায় বানানো ফলের রস, কিশমিশ, বাদাম, ডাবের পানি, বোরহানি ইত্যাদি খাওয়া যায়। খাওয়ার আধঘণ্টা পর দেড় থেকে দুই গ্লাস পানি খেয়ে নামাজ পড়তে যান।
ঈদের সময় খাবার খাবেন বুঝেশুনেঃ-যাঁদের বয়স কম, শারীরিক বা হজমেরও কোনো সমস্যা নেই, তাঁরা নিজের পছন্দমতো সবই খেতে পারেন, শুধু অতিরিক্ত না হলেই হলো, বিশেষ করে চর্বি-জাতীয় খাদ্য। বেশি মাংস খেলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা বেড়ে যায়। যাঁদের এনাল ফিশার ও পাইলস-জাতীয় রোগ আছে, তাঁদের পায়ুপথে জ্বালাপোড়া, ব্যথা ইত্যাদি বাড়তে পারে, এমনকি পায়ুপথে রক্তক্ষরণও হতে পারে। তাই প্রচুর পরিমাণে পানি, শরবত, ফলের রস, ইসবগুলের ভুসি ও অন্যান্য তরল খাবার বেশি খাবেন। পেটে গ্যাস হলে নাক্স ভূমিকা,ওষুধ খেতে পারেন। যাঁদের আইবিএস আছে, তাঁরা দুগ্ধজাত খাবার পরিহার করুন। দাওয়াতে গেলে পরিমিত খাবেন। অতিভোজন পরিহার করার চেষ্টা করবেন। হয়তো অনেক খাওয়া-দাওয়া টেবিলে সাজানোই থাকবে, কিন্তু খেতে বসলেই যে সব খেতে হবে তা নয়। রাতের খাবার খেয়েই ঘুমিয়ে পড়বেন না। খাওয়ার অন্তত দুই ঘণ্টা পর বিছানায় যাবেন। খাবারের ফাঁকে ফাঁকে পানি খাবেন না, এতে হজম রসগুলো পাতলা হয়ে যায়। ফলে অনেক সময় হজমে অসুবিধা হয়। তাই খাওয়ার অন্তত এক ঘণ্টা পর পানি পান করুন।★ঈদের সময় চর্বি এড়িয়ে চলুন : অতিরিক্ত চর্বি খাওয়া এমনিতেই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কোরবানির সময় এ বিষয়টি বিশেষভাবে খেয়াল রাখা উচিত। অনেক সময় দেখা যায়, আমরা রান্না সুস্বাদু হবে মনে করে মাংসে বেশ কিছু চর্বি আলাদাভাবে যোগ করি, এমন ধারণা একেবারেই ভুল। মাংসের সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে সবজি খাওয়া যেতে পারে। টাটকা সবজি পাকস্থলীকে সাবলীল রাখে। পরিমিতি বোধ যেখানে রসনা সংবরণ করতে পারে, সেখানে ভয়ের কিছু নেই। মাংসে তেল বা ঘিয়ের পরিমাণ কমিয়ে দিলে, ভুনা মাংসের বদলে শুকনো কাবাব করে খেলে, কোমল পানীয় ও মিষ্টি একেবারে কমিয়ে খেলে কোরবানির ঈদের সময়ও ভালোই থাকা যায়। সেই সঙ্গে হালকা ব্যায়াম বা বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে শরীর থেকে অতিরিক্ত ক্যালরি কমিয়ে নিতে পারলে আরও ভালো।★ঈদের সময়বয়স্কদের থাকতে হবে সচেতনঃ-মধ্যবয়সী এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের খাবার সম্পর্কে সচেতন থাকা আরও জরুরি। এমনকি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে অতিরিক্ত চর্বি ইত্যাদি না থাকা সত্ত্বেও এই বয়সের মানুষের ঈদের খাবারের ব্যাপারে বাড়তি সতর্ক থাকা দরকার। অতি ভোজনে তাঁদের পেট ভরা ভাব, অস্বস্তিকর অনুভূতি, বারবার ঢেঁকুর ওঠা এমনকি বুকে ব্যথা পর্যন্ত হতে পারে। বেশি মাংস খেলে তা পরিপূর্ণভাবে হজম হতে সময় লাগে। ডায়াবেটিস রোগীকে অবশ্যই মিষ্টিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। তারা বরং টক খাবারের মাধ্যমে রসনা পূরণ করতে পারেন। নেহাত মিষ্টি খেতে চাইলে চিনির বিকল্প দিয়ে তৈরি করে নেবেন। পোলাও, বিরিয়ানি কম খাবেন। গরু বা খাসির মাংস খাওয়া যাবে, পরিমাণটা অতিরিক্ত যাতে না হয় এবং চর্বি যেন কম থাকে।
ঈদের সময় উচ্চরক্তচাপ, স্ট্রোক এবং হৃদরোগীরাঃ-অতিরিক্ত গরুর মাংস খেলে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বেড়ে যায়। শুধু গরু নয়, মহিষ, ছাগল ও খাসির মাংসে থাকে উচ্চমাত্রার প্রোটিন ও ফ্যাট, তাই অতিরিক্ত মাংস খেলে স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও কোলেস্টেরল এর মাত্রা বেড়ে যায়, বিশেষ করে যারা আগে থেকেই এসব রোগে ভুগছেন তাদের ঝুঁকি আরও বেশি। তাই মাংস খাওয়ার সময় অবশ্যই খেয়াল রেখে পরিমিত পরিমাণে এবং চর্বি ছাড়িয়ে খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সারা বছর তাঁরা যে ধরনের নিয়মকানুন পালন করেন খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে, কোরবানির সময়ও সেভাবে চলাই ভালো। কোরবানির মাংস একটু-আধটু খেলে শরীরের যে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে তা নয়, তবে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। যাঁদের ওজন বেশি, তাঁদের অবশ্যই ঈদের সময় খাওয়ার ব্যাপারে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে।
ঈদের সময় কিডনি রোগীদেরঃ- যাঁরা কিডনির সমস্যায় ভোগেন, যেমন ক্রনিক রেনাল ফেইলুর, তাঁদের প্রোটিন-জাতীয় খাদ্য কম খেতে বলা হয়। তাই মাংস খাবার ব্যাপারে আরও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কোনোক্রমেই অতিরিক্ত মাংস খাওয়া ঠিক হবে না। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সারা বছরের মতো ঈদের সময়ও একই খাবার খাওয়াই ভালো।
ঈদের মাংস সংরক্ষণঃ-কোরবানির পরে মাংস বিলিয়ে দেওয়ার পরেও দেখা যায় ঘরে অনেক মাংস জমা থাকে, তা ভালোভাবে সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি। ফ্রিজে সংরক্ষণ সম্ভব হলে ভালো। তবে গ্রামগঞ্জে এমনকি শহরে অনেকের বাসায় ফ্রিজ না থাকলে সঠিকভাবে মাংস জ্বাল দিয়ে রাখতে হবে। এমনকি মাংস সেদ্ধ কওে শুকিয়ে শুঁটকির মতো করে অনেক দিন খাওয়া যেতে পারে। খাবার আগে খেয়াল রাখতে হবে, যেন মাংসের গুণগত মান ঠিক থাকে।পরিশেষে ঈদ আনন্দের। আর খাবারের তৃপ্তি না থাকলে এ আনন্দ যেন পূর্ণতা পায় না। তবে তা হতে হবে পরিমিত। ঈদের উৎসব আনন্দ আগেও ছিল, চলছে এবং ভবিষ্যতেও চলতেই থাকবে। খাওয়া-দাওয়ারও উৎসব আনন্দ অতিভোজন একইভাবে চলবে। অন্তত একটা দিন হলেও সবার এমন ইচ্ছা থাকে। তারপরও সবাইকে রয়ে-সয়ে খেতে হবে। কারণ অসংযমীভাবে খাদ্যগ্রহণ করে শুধু শুধু এই করোনাকালে ডাক্তারের কাছে কিংবা হসপিটালে ছোটাছুটির আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা ভেবে দেখতে হবে। সে ক্ষেত্রে ভোগান্তি বাড়বে বই কমবে না। ঈদ এবং ঈদ-পরবর্তী সময়ে ভালো থাকতে হবে, খাবারের বিষয়ে পরিমিতি জ্ঞান ও সংযম পালন করতে হবে। এভাবেই উৎসবও চলতেই থাকবে, স্বাস্থ্যটাও যেন ভালো থাকে। কারণ স্বাস্থ্য ভালো থাকলে উৎসবটাও ভালো কাটবে। সবাইকে মনে রাখতে হবে, এবারের ঈদ অন্য সাধারণ ঈদের মতো নয়। ঈদ উদযাপনের পাশাপাশি স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপারটি সবাইকে নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।
কুরবানি ঈদের কিছু পরামর্শঃ-
* মাংস খাওয়ার লোভে পড়ে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে নিজের ওজন বাড়িয়ে বসবেন না। স্বাস্থ্যই সুখের মূল- কথাটা ভুললে চলবে না।
* গরু, মহিষ, খাসি ও ভেড়ার মাংসে থাকে প্রচুর পরিমাণে কোলেস্টেরল। বেশি মাংস খেলে দীর্ঘমেয়াদে আপনার স্বাস্থ্য বিশেষত হার্টের ক্ষতি হতে পারে।
* কম মাংস খাওয়ার জন্য বেশি বেশি মাংস গরিব মিসকিনকে দিয়ে দিন। মনে রাখবেন দৈনিক ৯০ গ্রামের উপর মাংস খেলে বেড়ে যাবে ক্যানসারসহ হার্টের রোগ।
* মাংসের চর্বিযুক্ত অংশ বাদ দেয়ার চেষ্টা করুন। এছাড়া মগজ, চর্বি এবং ভুড়ি না খাওয়াই ভালো।
* যদি মাংস খেতেই হয়, তাহলে সেদ্ধ ও কয়লায় পুড়িয়ে খাওয়ার চেষ্টা করুন। বিশেষ করে কাবাব খাওয়া সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর। বেশি তেল দিয়ে অতিরিক্ত ভাজা মাংস খাওয়া যাবে না।
* কখন খাবেন এ বিষয়ে ডায়েটিশিয়ান ও ডাক্তারদের উপদেশ মানুন। ঘুমানোর অন্তত দুই ঘণ্টা আগে রাতের খাওয়া শেষ করতে হবে। রাতের খাওয়া শেষে আধা ঘণ্টা হেঁটে আসুন।
* বেশি পরিমাণ মাংস যেহেতু খেতেই হবে তাই খাদ্যতালিকায় প্রচুর পরিমাণ মাংস রাখুন। একেবারে বেশি বেশি না খেয়ে একটু পরপর অল্প অল্প করে খান। মাংস খাওয়ার ফলে যেহেতু দৈনিক ক্যালরির পরিমাণ বেড়ে যায় তাই ডেজার্ট এবং মিষ্টি খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিন।* ঈদের এই কয়েকদিনে অনেকগুলো দাওয়াত পাবেন। জানেন যে এড়াতে পারবেন না, মাংস খেতেই হবে। আর মাংস খেলে হবে হজমের গণ্ডগোল। তাই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় চিনি ছাড়া লেবুর রস এবং গ্রিন টি রাখতে পারেন।
ঈদ নিরাপদ হোক।
লেখক,
সম্পাদক ও প্রকাশক,দৈনিক স্বাস্থ্য তথ্য
স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা, হিউম্যান রাইটস রিভিউ সোসাইটি কেন্দ্রীয় কমিটি
কো-চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ রোগী কল্যাণ সোসাইটি