নিজস্ব প্রতিবেদক
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ (কোভিড-১৯) থেকে সুরক্ষা পেতে দেশে দেশে টিকা দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে এই টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া একটি বহুল আলোচিত বিষয়। শরীরে টিকা প্রবেশের কিছু ঘণ্টা পর যেসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া শুরু হয় তার অধিকাংশই মৃদু প্রকৃতির। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে বিপজ্জনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি রয়েছে, যেখানে জীবন বাঁচাতে জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হবে। তবে আশার কথা হলো, এরকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার হার খুবই কম- বিরল বললেই চলে।
গবেষকদের মতে, কিছু মানুষের টিকা জনিত মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি বেশি। একারণে করোনার টিকা নেওয়ার আগে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো (রিস্ক ফ্যাক্টর) জেনে রাখা উচিত। এই বিষয়ে সঠিক জ্ঞান ঝুঁকি কমাতে বা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি এড়াতে সাহায্য করবে।
করোনার টিকায় বিভিন্ন মাত্রার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। মৃদু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো এমন ইমিউন রিয়্যাকশন যা শরীরে অল্প প্রদাহ সৃষ্টি করে। তাই টিকার স্থানে ব্যথা করলে আশ্চর্যের কিছু নেই। উল্লেখযোগ্য মৃদু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো হলো- জ্বর, শরীর ব্যথা, দুর্বলতা ও ঠান্ডা লাগা।
অপরদিকে কিছু লোকের ক্ষেত্রে টিকা গ্রহণে বিপজ্জনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও হতে পারে। চিকিৎসকেরা এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে অ্যাডভার্স রিয়্যাকশন বলে থাকেন। সাধারণত সময় পরিক্রমায় এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে, কিছুক্ষেত্রে দ্রুতও হতে পারে। অ্যাডভার্স রিয়্যাকশনে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ক্ষতি হতে পারে। এগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত। শরীরের অংশবিশেষ বা সমগ্র শরীর অ্যাডভার্স রিয়্যাকশনের আওতায় আসতে পারে।
চিকিৎসকেরা বলছেন যে, করোনার টিকা নিরাপদ ও কার্যকর। কিন্তু তারা এটাও জানান যে, মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিরল ঝুঁকিও রয়েছে। এখনও পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের করোনার টিকা গ্রহণে যেসব বিপজ্জনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে তা হলো- জনসন অ্যান্ড জনসন ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকায় রক্ত জমাটবদ্ধতা, জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকায় গিলেন-বেয়ার সিন্ড্রোম বা শরীরের ইমিউন সিস্টেম কর্তৃক স্নায়ুর ধ্বংসসাধন, ফাইজারের টিকায় হার্টে প্রদাহ, অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকায় স্নায়ুতাত্ত্বিক জটিলতা ও অধিকাংশ টিকায় অ্যালার্জিক রিয়্যাকশন বা অ্যানাফাইলেক্সিস।
সাধারণত মৃদু প্রকৃতির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ২-৩ দিনে দূর হয়ে যায়, কিন্তু তীব্র ও বিপজ্জনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (অ্যাডভার্স রিয়্যাকশন) সেরে ওঠতে দীর্ঘসময় লাগতে পারে- এসময় চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা উচিত, কতদিন হাসপাতালে থাকতে হবে তিনি বিবেচনা করবেন।
যাদের বিপজ্জনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি বেশি
অনেকেই কোভিড-১৯ থেকে রক্ষা পেতে করোনার টিকা নিতে চাচ্ছেন, কিন্তু বিপজ্জনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার খবর শুনে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। তাই আবারও মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে- সবসময় বিপজ্জনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে না, সারাবিশ্বে হাতেগোনা কয়েকজনের এমনটা হয়েছে। এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলেও চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া যায়।অন্যদিকে যাদের টিকা গ্রহণে বিপজ্জনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার উচ্চতর ঝুঁকি রয়েছে তারা কিছু বিষয়ে সচেতন থাকলে পরিণতি এড়ানো সম্ভব হবে। যা হোক, চলুন জেনে নেওয়া যাক, করোনার টিকায় কাদের বিপজ্জনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
যাদের পূর্বে মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে
যদি পূর্বে কোনো টিকা গ্রহণের পর বিপজ্জনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে, তাহলে আপনার করোনার টিকা গ্রহণে অ্যাডভার্স রিয়্যাকশনের উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। এমনকি যেকোনো ওষুধ গ্রহণে মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ইতিহাস থাকলেও সাবধানতার জন্য নিজেকে ঝুঁকিপূর্ণ লোকের তালিকায় রাখতে হবে। এখনও পর্যন্ত করোনার টিকা গ্রহণে বিপজ্জনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে কিনা এটা নির্ণয়ের জন্য কার্যকরী পদ্ধতি নেই, কিন্তু যাদের পূর্বে অন্যকোনো টিকা বা ওষুধের প্রতি উদ্বেগজনক প্রতিক্রিয়া হয়েছে তাদের সচেতনতা অবলম্বনের প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। যাদের অটোইমিউন রোগ আছে তাদেরকেও সচেতন থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, সচেতনতায় ঝুঁকি কমে।
যাদের প্রথম ডোজে অ্যালার্জিক রিয়্যাকশন হয়েছে
করোনার টিকার প্রথম ডোজ নিয়ে অ্যালার্জিক রিয়্যাকশন বা অ্যানাফাইলেক্সিস হলে দ্বিতীয় ডোজেও অনুরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা অ্যাডভার্স রিয়্যাকশনের ঝুঁকি রয়েছে। প্রথম ডোজে অ্যালার্জিক রিয়্যাকশনের মানে হলো, ওই টিকায় এমনকোনো উপকরণ রয়েছে যার প্রতি আপনি সংবেদনশীল। তাই ডোজ নেওয়ার আগে-পরে সর্বোচ্চ সাবধানতা আবশ্যক। বিশেষ করে, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কোনো লক্ষণ দেখলেই দ্রুত চিকিৎসককে জানাতে হবে। এমনকি সপ্তাহ দু’একের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া পেলেও চিকিৎসককে অবহিত করা ভালো। কোনো টিকার প্রথম ডোজে অ্যালার্জিক রিয়্যাকশন বা অ্যানাফাইলেক্সিস হলে পরবর্তীতে ভিন্ন টিকার দ্বিতীয় ডোজ নেওয়া যাবে কিনা বিবেচনা করা যেতে পারে।বিশেষজ্ঞদের মতে, যাদের ডিমে অ্যালার্জি রয়েছে তাদের করোনার টিকায় অ্যালার্জিক রিয়্যাকশন বা ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি বেশি।
যারা একসঙ্গে অনেক ওষুধ সেবন করেন
বিশেষজ্ঞরা জানান যে, কিছু ওষুধ করোনার টিকাকে অকার্যকর করতে পারে বা কার্যকারিতা কমাতে পারে। এছাড়া যারা একই সময়ে অনেক ওষুধ সেবন করেন তাদের বিপজ্জনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও হতে পারে। হতে পারে তা প্রেসক্রিপশনের ওষুধ অথবা নিজের বিবেচনায় ব্যবহৃত ওষুধ। যিনি যত বেশি ওষুধের ওপর আছেন, তার করোনার টিকা জনিত ভয়ানক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি তত বেশি। যারা ওষুধের কড়া ডোজ সেবন করেন তারাও ঝুঁকির বাইরে নয়। তাই দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগলে বা বহু ওষুধ সেবন করলে টিকা নেওয়ার পূর্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া ভালো।
* বয়স ও অন্যান্য ফ্যাক্টর
কিছুক্ষেত্রে বয়স, লিঙ্গ ও জিনগত প্রভাবও বিপজ্জনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার প্রভাবক হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা গ্রহণে যাদের রক্ত জমাট বেধেছে তাদের বেশিরভাগই বয়স্ক। আবার এই বয়স্কদের মধ্যে নারীদেরই সংখ্যা বেশি। অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকায়ও। ফাইজারের টিকায় অল্প বয়সী পুরুষদের (১৫-৩৫ বছর) হার্টে প্রদাহ হয়েছে। তাই পরিণতি প্রতিরোধে ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় ও সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসমূহ জেনে সচেতন থাকতে হবে।
তথ্যসূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া
বিএসডি/এমএম