কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই আমাদের ক্রমশ ধরে ফেলছে। এআই অ্যালগরিদম এখন আমাদের হরহামেশাই দাবা, পোকার কিংবা মাল্টিপ্লেয়ার ভিডিও গেমে হারিয়ে দিচ্ছে। মানুষের এমন সব ছবি তৈরি করছে, যা প্রকৃত ছবির সঙ্গে পার্থক্য বের করা কঠিন।
সংবাদ লেখার পাশাপাশি এআই প্রোগ্রাম এখন ভালোবাসার গল্প লিখছে। অনেক তরুণ চালকের চেয়ে ভালো গাড়ি চালাতে পারছে। এআই যেভাবে এগিয়ে চলেছে, তাতে মানুষের জন্য যথেষ্ট আশঙ্কার কারণ রয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন উল্টোটা।
তাঁদের মতে, এআইয়ের পক্ষে সাধারণ মানুষের সমকক্ষ হয়ে ওঠা এখনই সম্ভব নয়। এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে নিউইয়র্ক টাইমস।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এখন পর্যন্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিখুঁত হয়ে ওঠেনি। এর উদাহরণ হিসেবে ‘ওবোট’ নামের একটি প্রোগ্রামের কথা বলা যায়।
সায়েন্স টাইমসে সাংবাদিক ক্যারেন ব্রাউন ওবোট সম্পর্কে লিখেছেন, এআই চালিত স্মার্টফোন অ্যাপ ওবোটের লক্ষ্য হচ্ছে কম খরচে কাউন্সেলিং সেবা দেওয়া। সংলাপ ব্যবহার করে ব্যবহারকারীকে মানসিক আচরণের সাধারণ পদ্ধতিগুলো শেখাতে পারে এটি। তবে অনেক মনোবিদ সন্দিগ্ধ যে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগে যে আন্তসংযোগ ঘটে, সে ধরনের অনুভূতি কি এআই প্রোগ্রাম কখনো দিতে পারে।
শিকাগোভিত্তিক থেরাপিস্ট লিন্ডা মাইকেলস বলেন, এআইভিত্তিক অ্যালগরিদম ব্যবহার করে তৈরি করা অ্যাপগুলোর এখনো অনেক ঘাটতি রয়েছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় থেরাপির কাজ এ ধরনের অ্যাপে সমাধান করা যায় না। মানুষের মধ্যে যে সম্পর্ক তৈরি হয়, তা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করতে পারে না।
গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ সাধারণত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কোনো রোবটের সঙ্গে সহানুভূতিশীল আচরণ করে না। রোবটের পক্ষ থেকে মানুষের মধ্যে সেই অনুভূতি তৈরির পথও নেই।
একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো মানুষকে এমন একটি পরিস্থিতিতে রাখা হলো যে তিনি উপকারী এআইকে সহযোগিতা করতে পারেন। কিন্তু দেখা যাবে, তিনি তা ঠিকমতো করছেন না।
জার্মানির মিউনিখের লুডভিগ ম্যাক্সিমিলান বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক অফেলিয়া ডেরয় বলেন, ‘সাধারণত মানুষ ও রোবটের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় কিছু একটার অভাব দেখা দেয়। আমরা মূলত সম্পূর্ণ অপরিচিত কোনো ব্যক্তির সঙ্গেও এআইয়ের তুলনায় স্বচ্ছন্দ বোধ করি।’
কেন এমনটি ঘটে, তা খতিয়ে দেখতে অফেলিয়া ও তাঁর নিউরোসায়েন্টিস্ট সহকর্মীরা মিলে একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। এখানে গবেষকেরা ব্যক্তির সঙ্গে অপরিচিতের জুটি গড়েন।
কখনো মানুষের সঙ্গে অপরিচিত কোনো মানুষ, আবার মানুষের সঙ্গে রোবটের জুটি গড়া হয়। এরপর প্রতিটি জুটিকে মুরগি ও হরিণ শিকারের মতো কিছু খেলা খেলতে দেওয়া হয়। এতে তাঁরা দেখেন, সাধারণত এআইয়ের সঙ্গে আস্থার ঘাটতি থাকে। কারণ, এআইচালিত রোবট কেবল যুক্তি মেনে চলে ও অনুভূতিহীন। এটা নিজের যুক্তির বাইরে চিন্তা করতে অক্ষম এবং প্রয়োজনে সহযোগিতা করতে চায় না। তাই মানুষের পক্ষেও এআইকে এড়িয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া রোবট সহযোগিতার জন্য আগ্রহী থাকলেও মানুষ রোবটের সঙ্গে সহযোগিতার জন্য ততটা আগ্রহী হয় না।
গবেষক অফেলিয়া বলেন, এআই সহযোগিতা মনোভাবপূর্ণ হলেও অনেকে এর সঙ্গে নির্দ্বিধায় বিশ্বাসভঙ্গ করে। এর জন্য কোনো অপরাধ বোধেও ভোগে না, যেটা তারা মানুষের ক্ষেত্রে করে। ‘আপনি রোবটে উপেক্ষা করতে পারেন এবং তাতে আপনার মধ্যে শর্ত লঙ্ঘনের কোনো অনুভূতিও কাজ করবে না।’
‘এটাই বাস্তব জগতে জটিলতা তৈরি করতে পারে। আমরা যখন এআই নিয়ে ভাবি, তখন আমাদের ভবিষ্যৎ দুনিয়ার অনুষঙ্গ হিসেবে অ্যালেক্সা ও সিরিকে নিয়ে ভেবে থাকি। এসব সফটওয়্যারের সঙ্গে আমরা একধরনের ভুয়া অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তৈরি করতে পারি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বেশির ভাগ যোগাযোগ হবে শুধু একটি সময়ের জন্য এবং শব্দহীন আলাপচারিতা। ধরুন, কোনো হাইওয়েতে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন এবং একটি আপনার সামনে যেতে চাইছে। যদি দেখেন গাড়িটি চালকহীন, তখন আপনি ওই গাড়িকে যেতে দিতে চাইবেন না। এবং তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি আপনার এই অচালকসুলভ আচরণ ধরতে না পারে, তখন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
গবেষক ডেরয় বলেন, ‘সমাজে যেকোনো পর্যায়ে সহযোগিতা বজায় রাখতে হলে কিছু নির্দিষ্ট রীতিনীতি গড়ে তুলতে হয়। ভুল করে অপরাধবোধ মানুষকে সামাজিক রীতিনীতি মেনে চলতে শেখায়। আর এর মধ্যে অন্যদের সঙ্গে আপস করা এবং সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে মানুষ। কিন্তু আমরা এখনো সংবেদনহীন রোবট ও বটগুলোর জন্য সামাজিক বা নৈতিক রীতিনীতি তৈরি করতে পারিনি।’