নিজস্ব প্রতিবেদক
* এক মাসেই ১৩টি ট্রলারের অনুমোদন
* সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ
* প্রতিস্থাপনে নয়-ছয়ের সুযোগ নেই বলছেন বিশেষজ্ঞরা
২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে একাধিক মিডওয়াটার ট্রলার প্রতিস্থাপনের অনুমোদনের ঘটনায় অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সরকারি নীতিমালার তোয়াক্কা না করে মাত্র এক মাসেই ১৩টি ট্রলার, লং লাইনার ও সাপোর্ট ভেসেলের অনুমোদন দেওয়া হয়। অনুমোদন প্রক্রিয়ায় নিয়ম লঙ্ঘন, স্পেসিফিকেশনবিহীন কাগজপত্র, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে ট্রলার আনার অভিযোগও উঠেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) একটি অভিযোগপত্রে এ ঘটনাকে “কোটি টাকার লেনদেনে মোড়ানো একটি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি” বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
নিয়ম না মেনে এসব অবৈধ অনুমোদন দেওয়া হয় সাবেক আওয়ামী সরকারের আমলে। অবৈধ এসব অনুমোদন দেওয়ার সময় মন্ত্রণালয়ের সুনীল অর্থনীতি বিভাগের সর্বেসর্বা ছিলেন আওয়ামীলীগের সাবেক ক্ষমতাধর মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের পিএস এবং বর্তমানেও উপদেষ্টা ফরিদা আখতারের পিএস আবু নঈম মোঃ আব্দুস সবুর। দুদকের অভিযোগে এই কর্মকর্তাসহ উঠে এসেছে আরও একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের নজিরবিহীন অনিয়মের চিত্র। এদের মধ্যে রয়েছে মৎস্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক খন্দকার মাহবুবুল হল, (ব্লু-ইকোনমি) জোনের সিনিয়র সহকারী পরিচালক ড. মুহাম্মদ তানভীর হোসেন চৌধুরী, মৎস্য অধিদপ্তর চট্রগ্রামের ঊর্ধ্বতন সহকারী পরিচালক শওকত কবির চৌধুরী এবং পরিসংখ্যান কর্মকর্তা জহিরুল হকের নাম। অভিযোগে বলা হয়েছে – এদের মূল খলনায়ক ছিলেন জহিরুল হক৷ তিনিই মাঠ পর্যায়ে সকল গ্রাহককে এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কাজ করাতে বাধ্য করতেন৷ সকল লেনদেনের খুটিনাটি মাঠ পর্যায়ে তিনিই নির্ধারণ করতেন৷ ফলে এ সিন্ডিকেটের ক্যাশিয়ারও বলা হয় তাকে৷ সবুরের নেতৃত্বে এ মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতির নোঙ্গর ফেলা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
গ্রস টনেজের তথ্য ছাড়াই ৬টি মিডওয়াটার ট্রলারের অনুমোদন-
২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মৎস্য-৪ শাখার উপসচিব এইচ এম খালিদ ইফতেখার স্বাক্ষরিত এক আদেশে সী রিসোর্সেস লিমিটেডের ৬টি মিডওয়াটার ট্রলার আধুনিক ট্রলারে প্রতিস্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হয়। অনুমোদনে গ্রস টনেজের তথ্য না থাকলেও ১০ শতাংশ দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতা কমবেশির অনুমতি দেওয়া হয়।

স্পেসিফিকেশন কম বেশি করার সুযোগ না থাকলেও দেওয়া হয় অবৈধ সুবিধা। গ্রস টনেজও উল্লেখ করা হয়না।
অথচ নেভাল আর্কিটেক্টদের মতে, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রুল অনুযায়ী এত বড় সীমাবদ্ধতা লঙ্ঘনের সুযোগ নেই। এদিকে সামুদ্রিক মৎস্য আইনের ১৩ এর ১ অনুচ্ছেদে নির্ধারিত স্পেসিফিকেশন উল্লেখ করার কথা থাকলেও সে আইনেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয়েছে৷
নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিস্থাপনযোগ্য ও নতুন ট্রলারের ফিশ হোল্ড ক্যাপাসিটি সর্বোচ্চ ২০০ মেট্রিক টন এবং ভলিউম ৩৪৫ কিউবিক মিটার নির্ধারিত হলেও এই ৬ ট্রলারের ক্ষেত্রে ৪৪০ কিউবিক মিটারের অনুমোদন দেওয়া হয়। এটিও স্পষ্টতই সরকারি নির্দেশনার লঙ্ঘন।
স্পেসিফিকেশন ছাড়াও নজিরবিহীন অনুমোদন –

স্পেসিফিকেশন ছাড়াই প্রতিস্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হয় মের্সাস জালাল কর্পোরেশনকে
২০২৩ সালের ১৫ নভেম্বর মের্সাস জালাল কর্পোরেশনের এক ট্রলারের অনুমোদনপত্রেও অনিয়ম দেখা যায়। উপসচিব এইচ এম খালিদ ইফতেখারের স্বাক্ষরে এই অনুমোদনপত্রে কোনো স্পেসিফিকেশন উল্লেখ ছিল না। নেভাল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি নজিরবিহীন ঘটনা। তারা বলছেন- একটি ট্রলার কেমন মানদণ্ডে ও সাইজে তৈরি হবে সেটা অবশ্যই অনুমোদনপত্রে উল্লেখ করতে হবে। এখানেও সামুদ্রিক মৎস বিধিমালা ২০২৩ এর ১৩ এর ১ সম্পূর্ণভাবে লঙ্ঘণ করা হয়েছে৷
‘৩ ট্রলার প্রতিস্থাপন নিয়ে আবারও ‘নয়-ছয়’-
সম্প্রতি অভিযোগের ভিত্তিতে নির্ধারিত স্পেসিফিকেশন না থাকায় মৎস্য ট্রলার এফ,ভি রাঙ্গাচৌকা, এবং বটম প্রকৃতির চিংড়ি ট্রলার এফ,ভি মাগফেরাত (রেজিস্ট্রেশন নং এফ-৫০১৮), ও এফ. ভি. রহমত (রেজিস্ট্রেশন নং এফ- ৬৩৩৮) ট্রলারসমূহের প্রতিস্থাপনের আবেদন ফেরত পাঠায় মন্ত্রণালয়। এসব আবেদন আরও অধিকতর যাচাই বাছাই করে প্রেরণের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু সামুদ্রিক মৎস্য বিধিমালা ২০২৩ এর ১৩ অনুচ্ছেদে প্রতিস্থাপন নিয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা থাকলেও তা উপেক্ষা করে এই তিন ট্রলার নিয়ে ফিরতি চিঠি পাঠিয়েছেন মৎস্য অধিদপ্তেরের বর্তমান ডিজি ড মোঃ আব্দুর রউফ।

স্পেফিসিফিকেশন ইস্যুতে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের ভুল ব্যাখ্যা
ফিরতি চিঠিতে তিনি লিখেছেন- মৎস্য নৌযান আমদানি/স্থানীয়ভাবে নির্মানের জন্য টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন/নির্দিষ্টকৃত নমুনা অনুমোদনের লক্ষ্যে কোন নীতিমালা/গাইড লাইন নাই। বর্ণিত সভার প্রণীত সুপারিশমালার আলোকে মিডওয়াটার ট্রলারের জন্য দৈর্ঘ্য ৩০-৪৫ মিটার (+/-১০%) হিসেবে সূত্রোক্ত পত্রে প্রস্তাব করা হয়েছে। ইহা সদয় অবগতি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রেরণ করা হলো। কিন্তু আইন অনুযায়ী এমন নির্দেশনা না থাকায় তার এই চিঠিকে অবৈধ বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে সামুদ্রিক মৎস্য বিধিমালা ২০২৩ উপেক্ষা করে এভাবে পত্রের উত্তর দিয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সরকারি কর্মচারী ( শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ এর বিধি ২ মোতাবেক অসদাচরণ করা হয়েছে৷
কি বলা আছে আইনে?
সামুদ্রিক মৎস্য বিধিমালা ২০২৩ এর ১৩ এর (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- বাণিজ্যিক ট্রলার বা যান্ত্রিক মৎস্য নৌযান আমদানি বা স্থানীয়ভাবে তৈরী করার অনুমতির জন্য সংশ্লিষ্ট মালিককে পরিচালক বরাবর ৩ (তিন) ফর্দ আবেদনপত্র দাখিল করিতে হইবে এবং উক্ত আবেদনের সহিত সংশ্লিষ্ট ট্রলারের স্কেচসহ নির্দিষ্টকৃত নমুনার (Specification) বিবরণী বহি (Brochure) দাখিল করিতে হইবে।

সামুদ্রিক মৎস্য আইন-২০২৩ অনুযায়ী প্রতিস্থাপনের জন্য নির্ধারিত স্পেসিফিকেশনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এ বিধি উপেক্ষা করেই নির্দিষ্ট স্পেসিফিকেশন না দিয়ে অবৈধ অনুমোদন দেওয়া হয়ছে। বর্তমানেও এ তিনটি ট্রলারের অবৈধ অনুমোদনের জন্য জোর তদবির চলছে বলে দায়িত্বশীল সূত্র।
অনুমোদনপত্র বিক্রির অভিযোগ-
২০০৯ সাল থেকে শেখ পরিবারের সন্তান শেখ রুবেলের নামে জারি করা একটি অনুমোদনপত্র পরে শেখ হেলালের মাধ্যমে বিক্রি হয় চট্টগ্রামের এমপি দিদারকে। অনুমোদনপত্র হস্তান্তর সম্পূর্ণ অবৈধ হলেও মন্ত্রণালয়ের কোনো অনুমতি ছাড়াই এটি বিক্রি হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিক্রিতে সরাসরি আবু নইম মোঃ আব্দুস সবুর মধ্যস্থতা করেছেন বলে জানিয়েছে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র।
নিয়ম না মেনে লং লাইনারে পেলাজিক আহরণের অনুমোদন-

লং লাইনারে একইসাথে টুনা ও পেলাজিক আহরনে অবৈধ অনুমোদন
১৬ নভেম্বর আরও ৫টি লং লাইনার ট্রলারের অনুমোদনে টুনা ও পেলাজিক মৎস্য আহরণের অনুমতি দেওয়া হয়, যা বিশেষজ্ঞদের মতে প্রযুক্তিগতভাবে অসম্ভব। তারা বলেন, টুনার জন্য লং লাইনার এবং পেলাজিকের জন্য মিডওয়াটার ট্রলার প্রয়োজন। দুয়ের জন্য এক ট্রলারে অনুমোদন প্রতারণার সামিল।
কার্গো জাহাজকে মাছ ধরার ট্রলার-
২০২৪ সালের ৩ মে থাইল্যান্ড থেকে ‘এমভি ওয়াইকেপি-১’ নামের একটি ট্রলার তানজানিয়ার পতাকা নিয়ে আসে। এটি দেখতে মাছ ধরার ট্রলারের মতো হলেও, চট্টগ্রাম কাস্টমসের রিপোর্ট অনুযায়ী এটি আসলে একটি খালি কার্গো জাহাজ। পরে রাতের আঁধারে গোপনে মাল খালাস করা হয় এবং এটি রাখা হয় ওশান ডকইয়ার্ডে।

থাইল্যান্ড থেকে এমভি ওয়াইকেপি-১’ নামের একটি ট্রলার তানজানিয়ার পতাকা নিয়ে আসে বাংলাদেশে
পরবর্তীতে ১১ জুন মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করে, যারা ৮ জুলাই কার্যক্রম শুরু করে। তবে তদন্ত প্রতিবেদনেও ‘কার্গো হলেও দেখতে ফিশিং ভেসেলের মতো’ বলার মাধ্যমে এটিকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা হয়। এখন অবধি এ বিষয়ে কোন বাবস্থা নিতে পারেনি মন্ত্রণালয়।
সিন্ডিকেটে আরও যারা–
দুদকের অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে—এসব অনুমোদনের মূল কারিগর ছিলেন তৎকালীন মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের একান্ত সচিব এবং ব্লু ইকোনমি উইংয়ের যুগ্ম সচিব আবু নাইম আব্দুস সবুর। তার নির্দেশে বিভিন্ন সময়ে তদন্ত প্রতিবেদনেও সত্য গোপন করে ইতিবাচক প্রতিফলন দেখানো হয়।
পাশাপাশি ধরাকে সরা জ্ঞানকরে দেওয়া অবৈধ প্রতিস্থাপনের অনুমোদন। দুদকের অভিযোগে উঠে এসছে সবুর সহ আরও চারজোনের নাম। এদের মধ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের (ব্লু-ইকোনমি) জোনের সিনিয়র সহকারী পরিচালক ড. মুহাম্মদ তানভীর হোসেন চৌধুরী, মৎস্য অধিদপ্তর চত্ত্রগ্রামের ঊর্ধ্বতন সহকারী পরিচালক শওকত কবির চৌধুরী এবং পরিসংখ্যান কর্মকর্তা জহিরুল হকের নাম। এছাড়া চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা মশিউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় বশির নামের এক ব্যবসায়ী দীর্ঘদিন ধরে ট্রলার আমদানি ও জাল কালোবাজারির সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগে বলা হয়। শক্তিশালী এই সিণ্ডিকেটের মাধ্যমেই মাঠ পর্যায়ে থেকে মন্ত্রণালয়ে সর্বত্র চলছে রমরমা বাণিজ্য ।
প্রতিস্থাপনের অনুমোদনে ১০ শতাংশ কম-বেশি করা অসম্ভব বলছেন বিশেষজ্ঞরা-
মিডওয়াটার ট্রলারকে আধুনিক মিডওয়াটার ট্রলার দ্বারা প্রতিস্থাপনের অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কমবেশি করার সুযোগ নেই বলে স্পষ্ট জানিয়েছেন বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির নেভাল আর্কিটেকচার এ্যান্ড অফশোর ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. এস এম রশিদুল হাসান । তিনি বলেন,
“জাহাজের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, গভীরতা ও গ্রস টনেজ নির্ধারিত থাকে। সর্বোচ্চ ১-২ শতাংশ বিচ্যুতি হতে পারে। ১০ শতাংশ কম-বেশি করার অনুমোদন প্রযুক্তিগতভাবে অসম্ভব এবং বিপজ্জনক।”