নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাজারে শীতকালীন সবজির সরবরাহ বেড়েছে। সে অনুযায়ী সবজির দাম কমার কথা। কিন্তু কমেনি। উলটো বেড়েছে তিনগুণেরও বেশি। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কারণে যৌক্তিকভাবে সবজির দাম বাড়ার কথা প্রতি কেজিতে ১১ পয়সা।
কিন্তু বাস্তবে বেড়েছে ৩৬ পয়সা পর্যন্ত। গত ৩ নভেম্বর ডিজেলের মূল্য প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বেড়েছে। সে অনুযায়ী বগুড়ার মহাস্থানহাট থেকে রাজধানীর কাওরানবাজারে প্রতি কিলোমিটারে পরিবহণ খরচ বাড়ার কথা ছয় টাকা। কিন্তু বেড়েছে ১০ টাকা ৮০ পয়সা।
এর মূল কারণ চাঁদবাজি। ট্রাক থেকে প্রতি ট্রিপে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে দুই হাজার টাকা। এছাড়া তিনটি পয়েন্ট থেকে পুলিশ খরচ বাবদ প্রতি ট্রাক থেকে আদায় করা হয় এক হাজার ৫০০ টাকা। সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এরকম তথ্য।
প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সবজির খুচরা বিক্রেতা লাভ করছেন ক্রয়মূল্যের প্রায় দ্বিগুণ। অপরদিকে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি অনুযায়ী যে হারে পরিবহণ ব্যয় বাড়ানোর কথা তার চেয়ে তিনগুণেরও বেশি বাড়ানো হয়েছে।
অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, বগুড়ার মহাস্থানহাট থেকে রাজধানীর কাওরানবাজারে পণ্য পরিবহণে বগুড়া পৌর টোল পরিশোধ ও চাঁদা দিতে হয় ২০০ টাকা। যদিও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী কোনো পৌরসভা এ ধরনের টোল আদায় করতে পারে না।
নিয়মবহির্ভূতভাবে যেসব পৌরসভা টোল আদায় করছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বগুড়া, শেরপুর ও সিরাজগঞ্জ। সিরাজগঞ্জ ট্রাক মালিক সমিতির পক্ষ থেকে ট্রাকপ্রতি আদায় করা হয় ৫০ টাকা।
অপরদিকে সিরাজগঞ্জ মোড়, যমুনা সেতু গোলচত্বর ও টাঙ্গাইল মোড়ে ট্রাকপ্রতি হাইওয়ে পুলিশকে দিতে হয় মাসে ৫০০ টাকা। ট্রিপপ্রতি যমুনা সেতু টোলে এক হাজার ৪০০ ও কাওরানবাজারে পার্কিং বাবদ দিতে হয় ৫০০ টাকা। সাভারের আমিনবাজারে লাঠিয়াল বাহিনীকে দিতে হয় ১০০ থেকে ২০০ টাকা।
টোল আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে, বগুড়া পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম বাদশা বলেন, ট্রাক থেকে কোনো পৌর টোল আদায় করা হয় বলে আমার জানা নেই। যদি কেউ টাকা তুলে থাকে তাহলে সে চাঁদাবাজি করছে। এর সঙ্গে পৌরসভার কোনো সম্পর্ক নেই।
বগুড়ার শেরপুরের পৌর মেয়র জানে আলম খোকা বলেন, সবজির ট্রাক থেকে কোনো টোল আদায় করা হয় বলে আমার জানা নেই। তবে বাস টার্মিনাল থেকে টোল আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সম্প্রতি টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, তেলের দাম বাড়ার আগে মহাস্থানহাট থেকে পাঁচ টনের একটি ট্রাক কাওরানবাজারে আসতে ভাড়া নিত ১২ হাজার টাকা। আর এখন নিচ্ছে ১৬ হাজার টাকা। রাস্তায় যত খরচ হয় সবই ট্রাক ভাড়ার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
সবজি বিক্রিতে খুচরা বিক্রেতাদের অস্বাভাবিক লাভের চিত্র তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৫ নভেম্বর এক সবজি বেপারী মহাস্থানহাটে কৃষকের কাছ থেকে প্রতিকেজি কাঁচামরিচ কেনেন ৪০ টাকায়। কাওরানবাজার পর্যন্ত আনতে খরচ হয় আরও পাঁচ টাকা।
তিনি পাইকারি ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করেন ৪৮ টাকা দরে। পাইকার প্রতিকেজি কাঁচামরিচে আড়তের খাজনা দেন এক টাকা করে। দোকান ভাড়া বাবদ পাইকারের খরচ হয় আরও এক টাকা করে। এ হিসাবে প্রতি কেজি কাঁচামরিচের পেছনে পাইকারের মোট খরচ ৫০ টাকা।
আর পাইকার ওই মরিচ খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করেন ৫৫ টাকা দরে। পরদিন অর্থাৎ ১৬ নভেম্বর ওই মরিচ শান্তিনগর খুচরা বাজারে ১০০ টাকা ও হাতিরপুল বাজারে ১১০ টাকা দরে বিক্রি হয়।
১৫ নভেম্বর নাটোরের হবিতপুর থেকে কাওরানবাজারে আসা একজন শিম ব্যবসায়ী জানান, কাওরানবাজার পর্যন্ত শিম নিয়ে আসতে তার খরচ হয়েছে প্রতি কেজিতে ৩০ টাকা। ওই শিম তিনি পাইকারি ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করেছেন ৩৩ টাকা দরে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আড়তের খাজনা ও দোকান ভাড়া বাবদ পাইকারের খরচ হয় আরও দুই টাকা। সে অনুযায়ী প্রতি কেজি শিমে তার খরচ হয় ৩৫ টাকা করে। তিনি খুচরা বিক্রেতার কাছে ওই শিম বিক্রি করেন ৪০ টাকা দরে।
পরদিন ১৬ নভেম্বর শান্তিনগর বাজারে গিয়ে দেখা যায়, খুচরা বিক্রেতারা ওই শিম বিক্রি করছেন ৭০ টাকা দরে। আর হাতিরঝিলে ওই শিম ৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে দেখা যায়।
বেগুন, শশা, বাঁধাকপি, ফুলকপি, পটল, পেঁপে, মূলা, ধনেপাতা ও ঢেঁড়সসহ অন্যান্য সবজির ক্ষেত্রেও একই ধরনের চিত্র মিলেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বর্তমানে বাজারে সবজির সরবরাহ বাড়লেও দাম কমেনি। এর কারণ হিসাবে ব্যবসায়ীরা ডিজেলের দাম বাড়াকে দায়ী করছেন।
কিন্তু অনুসন্ধানে জানা যায়, যে হারে ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি হারে সবজির দাম বাড়ানো হয়েছে। গত ৩ নভেম্বর সরকার ডিজেলের দাম প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়েছেন।
সেই হিসাবে বগুড়ার মহাস্থানহাট থেকে কাওরানবাজার পর্যন্ত রাস্তায় (২০২ কিলোমিটার) একটি পাঁচ টনের ট্রাকের জ্বালানি খরচ বেড়েছে এক হাজার ২১২ টাকা। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া বাড়ার কথা ছিল ছয় টাকা।
কিন্তু প্রকৃত অর্থে বাড়ানো হয়েছে ১৯ টাকা ৮০ পয়সা। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রেক্ষাপটে প্রতিকেজি সবজির পরিবহণ ব্যয় ১১ পয়সা বাড়ানো উচিত ছিল। কিন্তু বাড়ানো হয়েছে ৩৬ পয়সা।
গোয়েন্দাদের পর্যবেক্ষণ, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শহরকেন্দ্রিক ভোক্তার কাছে সবজি পৌঁছার আগে বেশ কয়েকবার হাত বদল হয়। হাত বদল ও পরিবহণ চাঁদাবাজি ছাড়াও অসাধু ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফালোভী মনোভাবসহ নানা কারণে সবজির দাম বাড়ছে।
খুচরা ব্যবসায়ীদের মধ্যে পাইকারি ক্রয়মূল্যের ৭০-৮০ ভাগ লাভ করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা ইচ্ছে মতো দাম বাড়ানোর কারণে ভোক্তারা ভোগান্তির সম্মুখীন হচ্ছেন।
গোয়েন্দাদের সুপারিশ, সবজির দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষক থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত হাত বদল কমাতে হবে। পরিবহণ ব্যয় কমাতে বিভিন্ন পর্যায়ে চাঁদাবাজি বন্ধে কঠোর নজরদারি করতে হবে।
পাইকারি বাজার নিয়মিত মনিটরিংয়ের পাশাপাশি খুচরা বাজারের মূল্য তালিকা প্রস্তুত ও বাস্তবায়নে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
এছাড়া সব স্তরের সবজি ব্যবসায়ীদের এলাকাভিত্তিক তালিকা তৈরি জরুরি। একইসঙ্গে নীতিমালা প্রণয়ন করে ব্যবসায়ীদের এর আওতায় এনে খুচরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
বিএসডি/ এসএস