রাজধানীর বেদখল হয়ে যাওয়া খাল ও নালা উদ্ধার, সংরক্ষণ ও দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তুলতে নানা প্রকল্প হাতে নিয়েছে দুই সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) চারটি খালের আধুনিকায়নের জন্য ৯৮১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। পাশাপাশি নালা ও খালগুলোর আপাত সংরক্ষণের জন্য দুই সিটি ১৬১ কোটি টাকা চেয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছে। অন্যদিকে নালা ও খাল সংস্কার নিয়ে ঢাকা ওয়াসার চলমান দুটি প্রকল্প চালু রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।
গত বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব (খাল ও ড্রেনেজ) আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দুই সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তর করা হয়। এর মাধ্যমে ২৯টি খালের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পেয়েছে ডিএনসিসি আর ডিএসসিসি পেয়েছে ৫টি।
জানা গেছে, ডিএসসিসি তার আওতাধীন চারটি খালের জন্য ৯৮০ কোটি ৯১ লাখ টাকার প্রাক্কলন নির্ধারণ করে একটি প্রকল্প স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। প্রকল্পের নাম প্রথমে ‘সুন্দর ও নান্দনিক ঢাকা উন্নয়ন প্রকল্প’ দেওয়া হলেও পরে সংশোধন করে ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল পুনরুদ্ধার, সংস্কার ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি’ করা হয়। কালুনগর, জিরানি, মান্ডা ও শ্যামপুর খালের জন্য ওই প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া ধোলাইখাল, পান্থপথ ও সেগুনবাগিচার বক্স কালভার্ট পরিষ্কার ও পলি অপসারণের জন্য নিজস্ব অর্থায়নে ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে।
কালুনগর খালটি শহীদ বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব সরকারি মহাবিদ্যালয় থেকে রায়েরবাজার স্লুুইস গেট পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ। জিরানি খালের (নন্দীপাড়া ব্রিজ ত্রিমোহনী) দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার। মান্ডা খালের দৈর্ঘ্য ৮ দশমিক ২ কিলোমিটার। শ্যামপুর খালের দৈর্ঘ্য ৫ কিলোমিটার।
প্রকল্পে বলা হয়, পরিবেশের উন্নয়নের জন্য দক্ষিণ সিটি এলাকায় খালগুলোর পানি প্রবাহ ঠিক রাখা; খালে ময়লা-আবর্জনা না ফেলার বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ; পানিপ্রবাহ ঠিক রাখার মাধ্যমে মশকপ্রজনন বন্ধ করা; খাল পাড়ে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করে হাঁটার সুবিধা নিশ্চিত করা; গ্রিনবেল্ট ও বসার স্থান তৈরি করে বিনোদনমূলক ও জনসেবা ত্বরান্বিত করা; জলাশয়ে মাছ চাষের মাধ্যমে পুষ্টির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি নৌ-চলাচলের ব্যবস্থার মাধ্যমে জীবনযাত্রার মান ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করা। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ৫০ লাখ লোক জলাবদ্ধতার হাত থেকে রক্ষা পাবে বলে জানিয়েছে ডিএসসিসি।
কালুনগর খালের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭১ কোটি ১ লাখ টাকা। জিরানী খালের জন্য ২১৪ কোটি ১৮ লাখ, মান্ডা খালের জন্য ২৯৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা এবং শ্যামপুর খালের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২৩০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
উন্নয়ন কাজের মধ্যে রয়েছে নান্দনিক এক হাজার বাতি; সৌর বিদ্যুৎ প্যানেল; ড্রেনেজ স্ট্রাকচার; ড্রেনেজ লাইনসহ স্যুয়ারেজ ফিলটারিং সিস্টেম তৈরি; জলাশয়, খালের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা; জলাশয়-খালের নিচের পলি অপসারণ; নিকটবর্তী স্থাপনার সুরক্ষা; ভূমি উন্নয়ন; সবুজায়ন ও ল্যান্ডস্কেপিং; বৃক্ষরোপণ; ওয়াকওয়ে এবং বাইসাইকেল লেন; ওভারব্রিজ; মাছ ধরার নির্দিষ্ট স্থান; ফুডকোর্ট ও কফিশপ; প্লাজা নির্মাণ; বসার বেঞ্চ ও শেড নির্মাণ; ওয়েস্টবিন স্থাপন; সাইট দর্শনের স্থান; ইকো পার্ক ও বাচ্চাদের খেলার জায়গা তৈরি; পাবলিক টয়লেট; পার্কিং; ব্যায়াম করার স্থাপনা; ঢাল সুরক্ষা দেয়াল; আরসিসি রিটেনিং ওয়াল নির্মাণ; প্রোটেকশন সবুজায়ন; অ্যাপ্রোচ রোড (৫ মিটারের অধিক); গাড়ি চলাচল সেতু ও ফোয়ারা।
এ দিকে খাল ও নালা রক্ষণাবেক্ষণ করতে গত ২৮ জানুয়ারি স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর কাছে বরাদ্দ চেয়ে চিঠি দিয়েছেন ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম। চিঠিতে বলা হয়, বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন নালার ১৭৪ কিলোমিটার পরিষ্কার ও রক্ষণাবেক্ষণে তাদের ২১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা প্রয়োজন। ২৯টি খালের ভাসমান ময়লা-আবর্জনা সরাতে লাগবে ৫ কোটি ৭৪ লাখ। ১০ কিলোমিটার খাল খনন ও বর্জ্য তুলতে ২৫ কোটি ৬৪ লাখ, জরুরি ভিত্তিতে পরিষ্কার কার্যক্রমসহ বক্স কালভার্ট ও ইউ-টাইপ চ্যানেল পরিষ্কার ও রক্ষণাবেক্ষণে ৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ওই চিঠিতে। জানা যায়, একইভাবে আপাত কাজ সম্পাদনের জন্য ১০০ কোটি টাকা চেয়ে দ্রুতই চিঠি পাঠাবে দক্ষিণ সিটি।
ঢাকা মহানগরীর ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং খাল উন্নয়ন প্রকল্প নামে ওয়াসার একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা ও খালগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের হাতে ন্যস্ত হওয়ায় সেই প্রকল্পটি ওয়াসা আর বাস্তবায়ন করতে পারবে না। ৫৫০ কোটি ৫০ লাখ টাকার এ প্রকল্পে ইতোমধ্যে ১৩৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। প্রকল্পটি উত্তর সিটি এলাকায় হওয়ায় সংস্থাটি তা বাস্তবায়ন করতে চায়। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত আলোচনার অগ্রগতি হয়েছে।
এর বাইরে বাইশটেকি, কুর্মিটোলা এবং বেগুনবাড়ী খাল খনন/পুনর্খনন এবং ভূমি অধিগ্রহণ প্রকল্প নামে ওয়াসার প্রকল্পটিও বাস্তবায়ন করতে চায় উত্তর সিটি। ৬৪৫ কোটি ৫১ লাখ টাকার এ প্রকল্পের এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, আমরা খালগুলো নিয়ে নানা পরিকল্পনা নিয়েছি। আমরা চাই রাজধানীর খালের পাশ দিয়ে মানুষ হেঁটে বেড়াবে। সাইকেলের লেন হবে, গাছ লাগানো হবে। সুন্দর নগরীর জন্য খালে স্বচ্ছ প্রবহমান পানি থাকুক। সেখানে মাছের চাষ দেখতে চাই। ময়লা-আবর্জনামুক্ত খাল দেখতে চাই। খাল দিয়ে নদীর সাথে নৌকা চলাচলের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করতে চাই।
ডিএসসিসির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস এক সভায় বলেন, ওয়াসা থেকে খালের দায়িত্ব নেওয়ার পর খাল সংস্কার ও আধুনিকায়নে প্রায় ১১টি দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ৪টি খাল ও দুটি বক্স কালভার্ট চিহ্নিত করা হয়েছে। যা ঢাকা মহানগরীর পানি নিষ্কাশনের অন্যতম প্রধান চ্যানেল। এ খাল ও বক্স কালভার্টগুলো সংস্কারের জন্য আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে ক্রাশ প্রোগ্রাম গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি খালের অবৈধ স্থাপনা ও বর্জ্য অপসারণ কাজ চলমান রয়েছে। এই ৪টি খাল আধুনিকায়নের লক্ষ্যে প্রায় ৯৮১ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প প্রস্তাব স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া গত বছর যে সব স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় তার কারণ চিহ্নিত করে ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়নের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।