নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম ব্যুরো: বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বিশ্বে রোল মডেল। আমরা ডাবল ডিজিট প্রবৃদ্ধির পথে। সেই প্রবৃদ্ধি মাত্র একটি সমুদ্রবন্দর কিভাবে সামাল দিচ্ছে তা উন্নত বিশ্বের বন্দরগুলোর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ দেখে আশ্চর্য হচ্ছে। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বন্দরের অযুত সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম আবুল কালাম আজাদ।
বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা এবং সহযোগিতার কারণেই দেশের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে মিল রেখে আমরা চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করছি। আর আমাদের দক্ষ কর্মী, অভিজ্ঞ বন্দর অপারেটর ও স্টেকহোল্ডার এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নিজেদের ডেডিকেশন দিয়ে পণ্য উঠানামার বাড়তি লক্ষ্যমাত্রা পূরণের কাজটি নিরলসভাবে করে যাচ্ছেন।
রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দেশের এই প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলানো আমাদের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু আমাদের দক্ষ কর্মী বাহিনী, অভিজ্ঞ অপারেটর ও স্টেকহোল্ডার এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নিজেদের প্রচেষ্টা দিয়ে সেই কাজটি নিরলসভাবে করে যাচ্ছেন। আগামীর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে মিল রেখে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে সক্ষমতা বাড়ানোর কাজটি করছে। স্বল্পমেয়াদী প্রকল্পের মধ্যে পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল ২০২১ সালের জুনের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হচ্ছে। সেখানে চারটি জেটি দিয়ে আমরা বছরে চার লাখ একক কন্টেইনার ওঠানামা করতে পারব।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রথম দিকে আমাদের পরিকল্পনা ছিল নিজস্ব যন্ত্রপাতি দিয়েই পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনা করব। পরবর্তী সময় আমরা সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছি। এখন বিদেশি অপারেটর দিয়ে টার্মিনালটি পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হচ্ছে। সেই অপারেটরই এসওটি ভিত্তিতে নিজেরা আধুনিক যন্ত্রপাতি কিনে সংযোজন করে পণ্য ওঠানামা করবে।’
বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, “এখন বছরে আমরা ৩০ লাখ একক কনটেইনার ওঠানামা করছি। এই টার্মিনাল দিয়ে বছরে ৩৪ লাখ কনটেইনার ওঠানামা করতে পারব। অর্থাৎ ২০২৩ সাল পর্যন্ত পণ্য ওঠানামা সামাল দিতে পারব। পরবর্তী সময় আমাদের হাতে নতুন টার্মিনাল আসবে ‘মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর’ কিন্তু সেটি আসবে ২০২৫ সালে। ফলে ২০২৩ থেকে ২০২৫ সাল দুই বছর আমাদের সামাল দিতে হবে বিদ্যমান সক্ষমতা দিয়ে। কারণ সেই সময়ে আমাদের হাতে নতুন জেটি আসবে না। সেই দুই বছর সামাল দিতে আমরা একটি অর্ন্তর্বতীকালীন কর্মপরিকল্পনা নিয়েছি।”
রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘বন্দরের বহুল আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ মেগাপ্রকল্প বে টার্মিনালে জেটি-টার্মিনাল নির্মিত হতে সময় লাগবে। তার আগেই আমরা সেখানে প্রাথমিকভাবে কনটেইনার ইয়ার্ড ও ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ করব। আমাদের উদ্দেশ্য জাহাজ থেকে একটি কনটেইনার নামিয়ে ট্রাক-লরিতে সরাসরি টার্মিনালের কনটেইনার ইয়ার্ডে পৌঁছানো। সেখানে যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষ করে কনটেইনার ডেলিভারি। এর ফলে বন্দরের মূল জেটি-ইয়ার্ডে কনটেইনারের অনেক চাপ কমবে। তখন বন্দরের মূল জেটিতেই এখনকার চেয়ে আমরা অনেক বেশি কনটেইনার ওঠানামা করতে পারব।’
টার্মিনাল আমাদের অগ্রাধিকার প্রকল্প উল্লেখ করে বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, ‘আগামী ছয় মাসের মধ্যে আমরা বে টার্মিনালে কনটেইনার ইয়ার্ড ও ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ শুরু করতে চাই। বিদেশি প্রতিষ্ঠান সম্ভাব্যতা স্টাডি করছে। এর মধ্যে ওই অংশটুকুর প্রতিবেদন নিয়ে বন্দরের নিজস্ব তহবিল থেকে এই কাজ আমরা শুরু করে দেব। রিপোর্ট পাওয়ার পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে আমরা এর নির্মাণকাজ শেষ করব।’
তিনি বলেন, ‘পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের সক্ষমতা শেষ হওয়ার আগেই বে টার্মিনালের কনটেইনার ইয়ার্ড এবং ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ শেষ হবে। এরই মধ্যে বে টার্মিনালের মূল জেটি-টার্মিনাল নির্মাণে বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু করতে পারব। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সেই জেটি-টার্মিনাল-ইয়ার্ড নির্মাণ শুরু করে দেবে। সেই প্রকল্প চলতে চলতে আমরা ২০২৬ সালেই পাব কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর। সেই বন্দর চালু হলে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে ফিডার জাহাজ সার্ভিস চালুর প্রয়োজন পড়বে না। যেকোনো দেশ থেকে সরাসরি জাহাজ মাতারবাড়ীতে ভিড়তে পারবে।’
বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সামাল দিতে সরকার মোংলা বন্দরে নতুন কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করছে। কাজ শুরু করেছে পায়রা বন্দর। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্য পরিবহন সুবিধা দিতে এই দুই বন্দর অনেক সহায়ক হবে। ফলে সেই চাপটাও আমাদের থেকে কমবে। তা ছাড়া কর্ণফুলী নদীর দুই পারকে কাজে লাগাতে আমরা এরই মধ্যে সদরঘাটে লাইটার জেটি চালু করছি। আরো লাইটার জেটি তৈরি করছি। এ ছাড়া বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহিত করছি। তবে আপাতত চট্টগ্রাম বন্দরের মূল জেটি জিসিবি নতুন করে নির্মাণের প্রয়োজন নেই। কারণ ছোট ছোট লাইটার জেটি নির্মিত হলে জিসিবির চাপ কমে যাবে। সেই সঙ্গে বে টার্মিনাল নির্মিত হলে তো জিসিবিতে কনটেইনার জেটির প্রয়োজনীয়তা একেবারেই কমে যাবে। তখন জিসিবিতে আমরা শুধু বাল্ক বা খোলা জাহাজই ভেড়াব।