রেনেকা আহমেদ অন্তু: আমাদের দেশে নারীদের পাবলিক কিংবা ওপেন স্পেসের সুবিধার ভোগের সময় নানা বৈষম্যের
শিকার হতে হয়। নারীরা নিজেদের পেশাগত কাজের তাগিদে প্রায়শই পাবলিক স্পেস যাচ্ছেন, তবে সেখানে তাকে রোজ হতে হচ্ছে নানা সমস্যার শিকার। কখনো মৌখিকভাবে নারীরা হ্যারাসমেন্টের শিকার হচ্ছেন, কখনো বা হচ্ছেন শারীরিকভাবে। কখনো বা অনেক নারী মেনেই নিতে বাধ্য হচ্ছেন যে- “পাবলিক স্পেসে তো একটু ইভটিজিং ও মৌখিক যৌনসন্ত্রাসের শিকার তো হতেই হয়।”
এসব জেন্ডার ভিত্তিক অসমতা এবং এ বিষয়ে যুবনারীদের ভাবনা জানতেই সাহসী কন্যা ২জুন (বুধবার) বেলা ১২টায় জুমে ১৩৫ মিনিট ব্যাপ্তির ভার্চুয়াল গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করেছেন। এই আয়োজনটি গার্লস গেট ইকুয়াল ফ্রিডম ইন পাবলিক ¯েপসেস- সেফার সিটিস ক্যা¤েপইনের অংশ ছিল। আলোচনাটির সঞ্চালনায় ছিলেন রেনেকা আহমেদ অন্তু, ইয়ুথ অ্যাডমিনিস্টেট্রর অফ সাহসী
কন্যা এবং আলোচক হিসেবে যুক্ত ছিল রাজধানীর বিভিন্ন পাবলিক স্পেস নিয়মিত ব্যবহার করা পনেরজন ভিন্নভিন্ন (১৬-৩০) বয়সের যুব নারী।
নারীর স্বাধীনতা “নগরের ওপেন স্পেসে নারীদের সুবিধাভোগের প্রবেশাধিকারের কথা, জানতে চাওয়া হয় এসব
সুবিধাভোগে কি নারীদের কেবল নিজেদের জেন্ডার পরিচয়ের জন্য কোনো বিশেষ সমস্যা পোহাতে হয় কিনা?” এমন প্রশ্নে আলোচকরা এক এক করে বিভিন্ন পাব্লিক/ ওপেন স্পেসে নারীদের প্রবেশাধিকার না থাকার অলিখিত বাস্তবতার কথা জানান। এসময় আলোচক এক যুবনারী, ওপেন স্পেসে যাবার পূর্বে নারীদের পারিবারিক নিষেধাজ্ঞার কথা জানান।
তিনি তার বক্তব্যে উল্লেখ করে, কেন পরিবার
নারী এবং কন্যাশিশুদের বাহিরে যাবার বেলায় জেন্ডার বৈষম্যের শিকার হতে হয়। জানান- ওপেন স্পেসে নারীদের দৃশ্যতা/উপস্থিতি কম থাকার কথাও। এ পর্যায়ে আরেক আলোচক জানান- সামাজিক অলিখিত নিয়মাবলীর কথা। জানান যে –“সমাজ সবসময় বিনোদনের জন্য নারীর বাহিরে যাওয়াকে এক প্রকার “মন্দ” ব্যাপার বলেই শিখিয়েত এসেছে। তাই নগরের পার্ক, খেলার মাঠগুলো নারীবান্ধব
হয় খুব কম।” এসময় সকল আলোচকরাই নগরে খেলাধুলার জন্য নারীবান্ধব ওপেন স্পেসের অনুপস্থিতির কথা জানান। অনেকে সরাসরি খেলা দেখার উদ্দেশ্যে দর্শক হওয়ার বিড়ম্বনার নানা অভিজ্ঞিতার কথাও বলেন। হাইলাইট করেন, মৌখিকভাবে যৌন সন্ত্রাসের শিকার হবার ঘটনাগুলোও।
আলোচনায় অংশগ্রহনকারী কয়েকজন কন্যাশিশু তাদের নানা স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমে অংশগ্রহনের সময় সামাজিক বাধার কথা জানান। তারা বলেন- “সমাজ যেনো ধরেই নেয় যে মেয়ে কিংবা নারী মাত্রই সে মূলত ঘরেই থাকবে। একান্ত বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া তাদের পাবলিক স্পেসে যাওয়াটা অপ্রয়োজনীয়। খেলাধুলা-বিনোদনের জন্য মূলত ছেলেদেরই বাহিরে যাওয়া উচিত।” পাবলিক স্পেসে নারীর সমঅধিকার নিয়ে কথা বলার সময় আলোচকরা শপিংমলে, সিনেমা হলে, পার্ক, খেলার মাঠ, ইত্যাদি স্থানগুলোতে নারীদের উপস্থিতি কে সমাজের চোখে “অপ্রয়োজনীয়” কোন ব্যাপার ভাববার
অভ্যাসের কথা হাইলাইট করেন। নারীরা কিভাবে নিজেদের পোশাক-পরিচ্ছদের বিভিন্ন দ্রব্য (অন্তর্বাস) ক্রয়ের সময়ও প্রতিনিয়ত হ্যারাসমেন্টের শিকার হন সেই অভিজ্ঞতাগুলোও আলোচনায় যুবনারীদের কাছ থেকে উঠে আসে। নগরের ওপেন স্পেসগুলোকে নারীবান্ধব গড়ে তোলার জন্য
পাবলিক টয়লেটকেও গুরুত্বপূর্ন বলে আখ্যা করা হয় ।
গনপরিবহনে নারীর বাস্তবতা আলোচকরা গণপরিবহন ব্যবহারের ক্ষেত্রে জেন্ডার বৈষম্যের কথা জানান।
আলোচকরা জানান, আমাদের নগরের গণপরিবহনগুলো মোটেও নারীবান্ধব নয়। আমাদের গণপরিবহনে যদিও নয়টি সিট রিজার্ভ থাকে নারী-শিশু এবং প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য, কিন্তু অনেক সময় এসব রিজার্ভ সিটে নারীরা বসার সুযোগ পায় না। আমাদের গোলটেবিল আলোচনায় তিনজন আলোচক সম্মিলিতভাবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার জের ধরে জানান যে, “আমাদের নগরের গণপরিবহনে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যেই রিসার্ভড সিটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমতাবস্থায় এমন বাস্তবতা হরহামেশাই চোখে পড়ে যেখানে গাড়ির চালক এবং গাড়ির অন্যান্য যাত্রীরা ধরেই নেন যে, সংরক্ষিত আসন পুরন হয়ে গেলে আর কোনো বাড়তি নারীযাত্রীর গণপরিবহনে ওঠার প্রয়োজনীয়তা নেই”। এ
বিষয়ে অন্যান্য আলোচকরা ও এই সমস্যাজনিত বাস্তবতার সাথে একমত প্রকাশ করেন।
এসময় একজন আলোচক বলে- “আমাদের সমাজের অনেকে এখন পর্যন্ত পজেটিভ জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশন অর্থাৎ কেন নারীদের বিশেষ সুবিধা প্রয়োজন গণপরিবহনে ব্যবহারের ক্ষেত্রে সেই ধারণাটি পরিষ্কারভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম না। এর জন্য সবার প্রথমে যেটা দরকার তা হল-প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নৈতিক মূল্যবোধ চর্চার গুরুত্ব প্রদর্শন অর্থাৎ সকল মানুষকে পরিবার, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শিখে আসা প্রয়োজন যে নারী-পুরুষ একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়
বরং দুপক্ষই সমাজের সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগের এবং দায়িত্ব গ্রহণের সমান অধিকার পাবার যোগ্য” এক্ষেত্রে আলোচকরা নৈতিক মূল্যবোধ তৈরীর জন্য বিভিন্ন ক্যা¤েপইন এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় নৈতিকমূল্যবোধ চর্চাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করেন। পাবলিক গণপরিবহন গুলোতে নারী
শিক্ষার্থীরা যখন হাফ ভাড়া দিতে চান; সেসময়ের নানা অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার কথাও আলোচনায়
উঠে আসে।
আলোচকরা বলেন, যেকোন গণপরিবহনে নারী যাত্রীদের যত হরহামেশা- “সংরক্ষিত আসনে জায়গা নাই আর কোন নারী যাত্রী নিব না” কিংবা “মহিলা মানুষ এত চিল্লাচিল্লি করে গাড়িতে উঠেছেন তবুও হাফ ভাড়া দিচ্ছেন” ইত্যাদি অস্বস্তিকর বাক্য শুনতে হয়, তেমনটা কখনোই কোনো পুরুষ যাত্রীদের প্রতিদিনকার জীবনে নিয়মমাফিক শুনতে হয় না।
আইন ও মূল্যবোধ
সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য চাই- আইনের সঠিক ব্যবহার। যুবনারীরা জানান- রাষ্ট্রের সু স্পষ্ট যৌন সন্ত্রাস বিরোধী আইন ও পলিসি নারীদের ওপেন¯েপসে স্বাধীনতা নিশ্চিকরনে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম। আলোচনার শেষ পর্যায়ে সকল আলোচকদের কাছেই জানতে চাওয়া হয়-
“নিরাপদ নারীবান্ধব শহরের এমন একটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলুন- যা সাধারনত প্রত্যেক যুবনারীই একটি শহরকে নিরাপদ শহর ভাবার জন্য আবশ্যক মনে করেন”। এমতাবস্থায় সকল আলোচকদের কাছ থেকে সম্মিলিতভাবে যে তিনটি বিষয় উঠে এসেছে তা হল-
ক) সু-স্পষ্টভাবে যৌন সন্ত্রাসভিত্তিক আইন প্রনয়ন ও কার্যকারিতা,
খ) নৈতিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে নারীর ওপেন ¯েপস ব্যবহারের দৃশ্যকে একটি স্বাভাবিক ব্যাপার বলে
ভাবতে শেখা এবং
গ) নগরের গণপরিবহন এবং ওপেন ¯েপসগুলো নারীদের ব্যবহার উপযোগী হিসেবে ডিজাইন করা
এবং ওপেন স্পেস এর সুবিধা ভোগের জন্য নারীদের যেসব প্রাসঙ্গিক সুযোগ সুবিধা-থাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে সেগুলো কে “প্রিভিলেজ” না মনে করে “পজিটিভ জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশন” এর উদাহরণ হিসেবে সমাজের সকলকে বিশেষত পুরুষ সদস্যদের ভাবতে শেখানোর প্রক্রিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়েছে। আলোচকরা আহ্বান করেন- প্রতিটি স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, সোশ্যাল
নেটওয়ার্কিং প্লাটফর্ম তথা সমাজের প্রত্যেকটি স্তরের মানুষকেই নারীবান্ধব নগরায়নের গুরুত্ব
অনুধাবন করতে হবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সোচ্চার হতে হবে।
লেখক- নৃবিজ্ঞানের বিভাগের শিক্ষার্থী,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।