সচিবালয়ে প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (এওপিও) পদে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ নিয়ে ব্যাপক জটিলতা দেখা দিয়েছে। এই জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ে নন-ক্যাডার কোটায় সহকারী সচিব পদে পদোন্নতি হবে। এ কারণে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যে খসড়া জ্যেষ্ঠতা তালিকা প্রকাশ করেছে, সেখানে এখন পর্যন্ত অন্তত একটি বিষয়ে বড় ধরনের ত্রুটি চিহ্নিত হয়েছে। এছাড়া নিয়োগবিধি লঙ্ঘন করে পদোন্নতি ও জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের অভিযোগ তুলেছেন সংক্ষুব্ধরা। এ বিষয়ে আপত্তি ও সংশোধন প্রস্তাব দিয়ে অর্ধশতাধিক আবেদন জমা পড়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে।
প্রসঙ্গত, নন-ক্যাডার কোটায় সহকারী সচিবের শূন্যপদে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য এওপিওদের জ্যেষ্ঠতা তালিকা হালনাগাদ করতে ৩ নভেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবালয় শাখা থেকে একটি খসড়া তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। ওই তালিকার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কারও কোনো আপত্তি, অভিযোগ কিংবা পরামর্শ থাকলে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে জানাতে বলা হয়। যার সময়সীমা শেষ হয়েছে ১৫ ডিসেম্বর।
প্রাপ্ত অভিযোগের মধ্যে প্রথমত, যারা ইতোমধ্যে চাকরি থেকে অবসরে চলে গেছেন তাদের অনেকের নামও তালিকায় অন্তুর্ভুক্ত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, নিয়োগবিধি অনুযায়ী স্নাতক বা সমমানের ডিগ্রি থাকায় যে কর্মকর্তা অনেক আগেই পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জন করেছেন, তার জ্যেষ্ঠতার সিরিয়াল চলে গেছে অনেক নিচে। বিপরীতে এইচএসসি বা সমমানের শিক্ষাগত যোগ্যতার কারণে যারা পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জন করেছেন অনেক পরে, তাদের সিরিয়াল ওপরে নির্ধারণ করা হয়েছে। তৃতীয়ত, নিয়োগবিধি লঙ্ঘন করে বেশ কয়েকজনকে ইতঃপূর্বে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। বিধি অনুযায়ী তাদের পদোন্নতি অবৈধ। অথচ ওইসব প্রশাসনিক কর্মকর্তার নাম ফিডার পদের খসড়া জ্যেষ্ঠতা তালিকায়ও যুক্ত করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, উল্লিখিত অনিয়মগুলোর বিষয়ে আপত্তি ও সংশোধনের প্রস্তাব দিয়ে প্রায় ৭০/৭৫টি আবেদন জমা পড়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। সংশ্লিষ্ট শাখা আগামী সপ্তাহ থেকে এসব আবেদন পর্যালোচনা শুরু করবে। এসব আবেদনের মধ্যে কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে করলেও অনেকে করেছেন একসঙ্গে। সেখানে কোনো কোনো আবেদনে ৫০ জনেরও স্বাক্ষর রয়েছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক কর্মকর্তা জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের সিরিয়াল নিয়ে আপত্তি ও সংশোধন প্রস্তাব দিয়েছেন। এছাড়া আবেদনকারীদের অনেকে যুগান্তরকে জানিয়েছেন, বর্তমানে যে জ্যেষ্ঠতা তালিকা বিবেচনায় নিয়ে সহকারী সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে সেটিও ত্রুটিপূর্ণ, যা ২০১৮ সালে প্রণয়ন করা হয়।
প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বর্তমানে সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বয়সসীমা ৫৯ বছর। এ হিসাবে যাদের জন্মতারিখ ১৯৬২, তারা একেবারে চাকরির শেষদিকে আছেন। অর্থাৎ তাদের এখন চাকরির শেষ বছর চলছে। যে কোনোদিন অবসরে যাওয়ার কথা। ১৯৬৩ সালে যাদের জন্ম, তাদের চাকরির বয়স বর্তমানে ৫৮ বছর। কিন্তু জন্মতারিখ যদি ১৯৬২ সালের আগে হয়, তাহলে তাকে অবসরে যেতে হবে। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এওপিওদের খসড়া যে জ্যেষ্ঠতা তালিকা প্রকাশ করেছে, সেখানে ১৯৫৮ সালে জন্ম নেওয়া কর্মকর্তা আছেন ৭ জন, ১৯৫৯ সালের ১০ জন, ১৯৬০ সালের ১৭ জন এবং ১৯৬১ সালের ১০ জন। এছাড়া ১৯৬২ সালে জন্ম নেওয়া (অবসর বছর) কর্মকর্তার নাম রয়েছে ১৫ জনের। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ৮৮২ জন এওপিওর নামের তালিকা থেকে এই তথ্য নেওয়া হয়েছে। যদি এটি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে বিষয়টি নিয়ে নিশ্চয় অনেক প্রশ্ন থেকে যাবে।
বিদ্যমান বাংলাদেশ সচিবালয় (ক্যাডারবহির্ভূত গেজেটেড এবং নন-গেজেটেড কর্মচারী) নিয়োগবিধি-২০১৪-এর ৩(ক) অনুযায়ী প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা পদে ৭ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতাসহ যিনি স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হতে কমপক্ষে স্নাতক বা সমমানের ডিগ্রি অর্জন করবেন, তিনি ফিডার পদের যোগ্যতা অর্জন করবেন। অর্থাৎ নন-ক্যাডার কোটায় সহকারী সচিব হওয়ার যোগ্য হবেন। পাশাপাশি বিধির ৩(খ) অনুযায়ী প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা পদে ১২ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতাসহ যিনি এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ তিনিও ফিডার পদের যোগ্যতা অর্জন করবেন। ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে তালিকায় এ ধরনের অসংগতি পাওয়া গেছে।
সরাসরি পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া এওপিওদের কয়েকজন যুগান্তরকে বলেন, খসড়া জ্যেষ্ঠতা তালিকা নির্ধারণের সময় বিধির গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে চাকরিতে যোগদানের তারিখ ধরে জ্যেষ্ঠতার সিরিয়াল বসানো হয়েছে, যা বিধিসম্মত হয়নি।
উদাহরণ দিতে গিয়ে তারা বলেন, উচ্চতর ডিগ্রিধারী একজন কর্মকর্তা ৭ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতাসহ ফিডার পদের যোগ্যতা অর্জন করেছেন ২০১৪ সালে। কিন্তু তার সিরিয়াল দেওয়া হয়েছে ৫০ জনের পরে। অথচ যিনি ফিডার পদের যোগ্যতা অর্জন করেছেন ২০১৯ সালে, তার সিরিয়াল আনা হয়েছে একেবারে প্রথমদিকে। তারা মনে করেন, শেষ পর্যন্ত যদি এভাবে সিরিয়াল বহাল থাকে, তাহলে সুস্পষ্টভাবে বিধিমালার লঙ্ঘন হবে। কেননা, শূন্যপদ সাপেক্ষে যদি ২০১৪ সালে ফিডার পদে থাকা আগের কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়ে যেতেন, তাহলে এখন তিনি সহকারী সচিব পদেই কর্মরত থাকতেন।
সংগত কারণে ভুক্তভোগীরা বলছেন, পদোন্নতির মাধ্যমে যদি সহকারী সচিব পদে ব্রাইট অফিসারদের যুক্ত করার ভিশন থাকে, তাহলে বিধির এই বিষয়টিকে অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রয়োজনে যারা অনার্স, মাস্টার্সসহ উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে সরাসরি পিএসসির মাধ্যমে দ্বিতীয় শ্রেণির পদে যোগ দিয়েছেন, তাদের জন্য পৃথক জ্যেষ্ঠতা তালিকা করে পদোন্নতি দেওয়া প্রয়োজন। ইতোমধ্যে বিগত ১২/১৩ বছরে ৩ শতাধিক কর্মকর্তা পিএসসির মাধ্যমে এওপিও পদে যোগ দিয়েছেন। যাদের শিক্ষাজীবনের ব্যাচমেটদের অনেকে ক্যাডার সার্ভিস চাকরি করছেন। এজন্য তাদেরকে নিয়োগবিধির মধ্যে রেখে আগে সহকারী সচিব করা হলে প্রশাসনের সুনাম বাড়বে, বৈ কমবে না। যুগান্তরের কাছে এভাবেই মতামত তুলে ধরেন সংশ্লিষ্টদের কয়েকজন।
অবশ্য এইচএসসি পাশ হলেও যারা ২৫/৩০ বছর ধরে চাকরি করছেন, তারা এ যুক্তি মানতে নারাজ। তারা মনে করেন, শিক্ষাগত যোগ্যতা আর বাস্তব কাজের অভিজ্ঞতা এক বিষয় নয়। অভিজ্ঞতার দিক থেকে তারা অনেক এগিয়ে। ফলে পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদার কথা বিবেচনায় নিয়ে সরকার চাকরির শেষ বয়সে তাদের সহকারী সচিব হওয়ার প্রত্যাশা থেকে কেন বঞ্চিত করবেন। নিশ্চয় করবেন না।
এদিকে খসড়া জ্যেষ্ঠতা তালিকায় এমন কিছু কর্মকর্তার নাম এসেছে, যাদের এওপিও পদে পদোন্নতি হয়েছে সম্পূর্ণ নিয়োগবিধি লঙ্ঘন করে। সচিবালয় নিয়োগ বিধি-২০০৬-এর বিধি মোতাবেক যাদের ওই সময়কার ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদ থেকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে পদোন্নতির কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু বিধি লঙ্ঘন করে সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এ ধরনের পদোন্নতি দিয়েছে। শুধু তাই নয়, তাদেরকে ইতিমধ্যে নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে জ্যেষ্ঠতাও দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি-১ শাখা থেকে ২০১১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর জারি করা এক পত্রে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়, এ ধরনের পদোন্নতি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া ওই মতামতে আরও বলা হয়, এ বিষয়ে বিধিগত চূড়ান্ত মতামত দেওয়ার এখতিয়ার একমাত্র জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের। পিএসসি কিংবা অন্য কোনো মন্ত্রণালয়/বিভাগ কর্তৃক মতামত গ্রহণযোগ্য নয়।
তৎকালীন বিধি-১ শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন (বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব, বিধি অনুবিভাগের প্রধান) স্বাক্ষরিত পত্রে বলা হয়, ‘এক বিধিমালার আওতায় নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা/কর্মচারী অন্য নিয়োগবিধিমালার ফিডার পদধারী হিসেবে গণ্য করতঃ পদোন্নতির যোগ্য বলে বিবেচিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং ‘দ্য কম্পিউটার পার্সোনাল (গভর্নমেন্ট অ্যান্ড লোকাল অথরিটিস) রিক্রুটমেন্ট রুলস-১৯৮৫’ অনুযায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত ডাটা এন্ট্রি অপারেটর/কম্পিউটার অপারেটররা ‘বাংলাদেশ সচিবালয় (ক্যাডারবহির্ভূত গেজেটেড কর্মকর্তা এবং নন-গেজেটেড কর্মচারী বিধিমালা, ২০০৬’ এর তফশিলভুক্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা/ব্যক্তিগত কর্মকর্তা পদে ফিডার পদধারী হিসেবে গণ্য করতঃ পদোন্নতির জন্য যোগ্য বিবেচিত হবেন না।’ অথচ এ রকম সুস্পষ্ট মতামত দেওয়ার পরও রহস্যজনক কারণে ওই সময় অন্তত ১৫টি মন্ত্রণালয়/বিভাগ থেকে বিধি লঙ্ঘন করে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি শাখার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা যুগান্তরকে জানিয়েছেন, ‘বিষয়টি যথাযথভাবে আমলে নেওয়া হলে প্রতিটি পদোন্নতি অবৈধ ও বেআইনি বলে বিবেচিত হবে। একই সঙ্গে যারা এভাবে পদোন্নতি দিয়েছেন, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করার সুযোগ রয়েছে। তবে এখন যেহেতু সহকারী সচিব পদে পদোন্নতির জন্য এওপিওদের ফিডার পদের জ্যেষ্ঠতা তালিকা চূড়ান্ত করা হচ্ছে, সেহেতু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নিশ্চয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’
এ প্রসঙ্গে সচিবালয় শাখার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানিয়েছেন, ‘যৌক্তিক ভুল কিংবা আপত্তি সংশোধনের জন্য এই খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। তাছাড়া এই তথ্যগুলো মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে তো একদিনে নেওয়া হয়নি। হয়তো যখন নেওয়া হয়েছে, তখন কেউ কেউ চাকরিতে ছিলেন।’ তিনি দাবি করেন, ‘যখন এটি চূড়ান্ত করা হবে, তখন সব ধরনের ভুলত্রুটি সংশোধন করে একেবারে নির্ভুলভাবে প্রকাশিত হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিধি লঙ্ঘন করে কারও পদোন্নতি নেওয়ার কিংবা দেওয়ার সুযোগ নেই। যদি এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে, সেটিও যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হবে।
বিএসডি/এসএফ