নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর ২৫টি চিহ্ণিত নালিশ উল্লেখ করে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ। দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে অভিযোগ পত্রটি দেওয়া হয়েছে। দলের চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক দায়িত্ব পাওয়া আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল ওই নালিশে কপি জমা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
কাদের মির্জার বিরুদ্ধে নিজে বাদি হয়ে ওই অভিযোগ দিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা খিজির হায়াত খান। তিনি বলেন, ‘কোম্পানীগঞ্জের বিবদমান সমস্যার সমাধানে দলকে রক্ষা করতে উপজেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কাদের মির্জার বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে নিজে বাদি হয়ে ওই অভিযোগ জমা দিয়েছি।’
অভিযোগে সাম্প্রতিক সময়ে মেয়র আবদুল কাদের মির্জা কর্তৃক দলের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতা, সংসদ সদস্য, প্রশাসন, নির্বাচন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বেফাঁস মন্তব্য, দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের বাড়িতে হামলা করা, ফার্ণিচার লুট করে দলের অফিস বন্ধ করে দেওয়া, হামলা চালিয়ে দলের সিনিয়র নেতাদেরকে লাঞ্ছিত ও পঙ্গু করা, গুলি করে দলের লোককে হত্যা করা, সরকারি কাজে ১০ শতাংশ কমিশন নেওয়া, ক্ষমতার অপব্যবহার ও স্বেচ্ছাচারিতাসহ ২৫টি অভিযোগ উল্লেখ করা হয়েছে বলেও খিজির জানান।
এ সব ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রতিকার চেয়ে কাদের মির্জাকে দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার, তাকে পৌর ভবনে সন্ত্রাসী নিয়ে অবস্থান করা থেকে বের করা, গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা, তার দেওয়া মিথ্যা মামলাগুলো প্রত্যাহার ও দলের নেতাকর্মীদের মুক্তিসহ বেশ কিছু দাবির বিষয়ও উল্লেখ করা হয়েছে ওই চিঠিতে।
আওয়ামী লীগ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় নির্বাচন, গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ ও সিভিল প্রশাসন, সংসদ সদস্য, সরকার ব্যবস্থাসহ নানামূখী বেফাঁস মন্তব্য করে এবার ফেঁসে যাচ্ছেন বসুরহাটের সেই আলোচিত মেয়র আবদুল কাদের মির্জা। বিগত চার মাস ধরে তার এসব বেফাঁস মন্তব্যের অডিও, ভিডিওসহ অসংখ্য প্রমাণ সংগ্রহ করেছে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। তারা লকডাউন শেষে সরেজমিনে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়ার বিষয়টিও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
সরকারি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাও কাদের মির্জা অতীত ও বর্তমান কর্মকাণ্ডের উপর তীক্ষ্ণ নজরদারী করছে বলে সূত্র জানিয়েছে। তবে, ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই হওয়ায় এতদিন কেন্দ্রীয় নেতারা চুপ থাকলেও দলের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি খতিয়ে দেখতে দলের নেতাদের দায়িত্ব দিয়েছেন বলেও জানা গেছে।
উপজেলা আওয়ামী লীগ ও কাদের মির্জার বিরোধে সংঘটিত সহিংসতায় একজন সাংবাদিকসহ দুই জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত ও পঙ্গু হয়েছেন আরও শতাধিক নেতাকর্মী। হত্যাসহ এসব ঘটনায় কোম্পানীগঞ্জ থানায় ১৮টি মামলা, আদালতে ১০টি পিটিশন ও থানায় শতাধিক সাধারণ ডায়রি (জিডি) করা হয়েছে। এ সব মামলায় দলের কয়েক হাজার নেতাকর্মীসহ স্থানীয় সাংবাদিকদেরকেও আসামি করা হয়েছে।
তবে এবার কাদের মির্জার লাগাম টেনে ধরতে মরিয়া কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। নেতাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিষোদগার করায় কাদের মির্জার ওপর দলের কেন্দ্রীয় নেতারা ক্ষুব্ধ। শুরুতে কাদের মির্জার পক্ষে ছিলেন এমন নেতারাও এখন বিরক্ত। কেন্দ্রীয় কিংবা কোম্পানীগঞ্জ আওয়ামী লীগের কোনো নেতাই এখন আর কাদের মির্জার পক্ষে নেই। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও তাকে চাপে রাখা হয়েছে। ফলে পরিণতি আন্দাজ করেই গত ৩১ মার্চ ফেসবুক লাইভে দল থেকে পদত্যাগ করার ঘোষণাও দিয়েছেন কাদের মির্জা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, কাদের মির্জা শুরুতে বেশ ভালো ভালো কথা বলছিলেন। পরে দেখা গেল তিনি পাগলের মতো নানা কর্মকাণ্ড করছেন। ফলে উনাকে এখন আর দলের কেউ ভালো চোখে দেখছেন না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের ভাইয়ের পরিচয়টার তিনি অপব্যবহার করছেন। বলা যায়, ভ্রাতৃস্নেহের অনৈতিক ফায়দা নিচ্ছেন তিনি। দলের যেকোনো পর্যায়ের নেতা উনার মতো অসংলগ্ন কথাবার্তা বললে বা সহিংসতায় জড়ালে অনেক আগেই দল থেকে বহিষ্কার হয়ে কারাগারে থাকতেন।
তারা আরও বলেন, কেন্দ্রীয় নেতারা দুটি বিষয় নিয়ে ভাবছেন। কাদের মির্জার পাগলামি অবশ্যই থামাতে হবে। একই সঙ্গে নোয়াখালী অঞ্চলে যাদের বিরুদ্ধে কাদের মির্জার বিরোধ রয়েছে, তা কি কারণে সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সর্বোপরি তদন্ত করে দলের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য রক্ষায় সবদিক বিবেচনায় নিয়েই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ।
এসব বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘অরাজকতা সৃষ্টি ও অরাজনৈতিক আচরণের সঙ্গে জড়িত কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। গোপন তদন্ত ও ঘটনাগুলোর মূল্যায়ন চলছে। লকডাউন শেষ হলেই দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা সামনাসামনি বসে তদন্তকাজ শেষ করবেন এবং কঠিন অ্যাকশনে যাবেন।’