নিজস্ব প্রতিবেদক,
প্রবাসী আয়ে বিশ্বে বাংলাদেশ এখন সপ্তম
গত এক যুগে দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনেও বড় সফলতা
একসময়ের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বাংলাদেশ আজ বিশ্বসভায় উন্নয়নের রোল মডেল। অনন্য এক উচ্চতায় বাংলাদেশ। উন্নয়ন অগ্রগতির সব সূচকে যুগান্তকারী মাইলফলক স্পর্শ করেছে। প্রবাসী আয়ে বিশ্বে বাংলাদেশ এখন সপ্তম। গত এক যুগে দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনেও বড় সফলতা দেখিয়েছে দেশটি। আর এসবই সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে।
সূত্র জানিয়েছে, এক কোটিরও বেশি প্রবাসী বিদেশ থেকে আয় পাঠাচ্ছেন। তাদের অবদানে গত ৩ মে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ৪৫ বিলিয়ন (সাড়ে চার হাজার কোটি) মার্কিন ডলারের মাইলফলক ছুঁয়েছে। রিজার্ভের এমন শক্ত ভিতের কারণে শ্রীলঙ্কার মতো দেশকেও এখন অর্থ সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারছে বাংলাদেশ।
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ এখন আর বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরশীল কোনো দেশ নয়, তার কারণ প্রবাসীরা। এই করোনা মহামারির মধ্যেও চলতি অর্থবছরে প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। আরেকটু সহজ করে বললে বলা যায়, সারা বিশ্ব মিলে বাংলাদেশকে এখন যে পরিমাণ ঋণ বা অনুদান দিচ্ছে বা সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) যে অর্থ আসছে, তার চেয়ে ছয় থেকে দশ গুণ পর্যন্ত বেশি অর্থ পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা, যার ওপর ভিত্তি করে দারুণ শক্ত অবস্থানে আছে দেশের অর্থনীতি।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয়ে পৃথিবীর শীর্ষ ১০ দেশের একটি বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করতে গেছেন, যার ৭৫ শতাংশই আছেন মধ্যপ্রাচ্যে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব, যেখানে আছেন প্রায় ২০ লাখ বাংলাদেশি। এই দেশটি থেকে প্রতি বছর গড়ে তিন থেকে চার বিলিয়ন ডলার আসে। অবশ্য ২০২০-২১ অর্থবছরে সেটি পাঁচ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
সৌদি আরবের পর সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আছেন আরব আমিরাতে, সংখ্যাটা অন্তত ১৫ লাখ। এ ছাড়া কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরাইনে গড়ে তিন থেকে চার লাখ বাংলাদেশি আছেন। মালয়েশিয়ায়ও ছয় থেকে সাত লাখ বাংলাদেশি আছেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি, সিঙ্গাপুর, ব্রæনাই, জর্ডান, লেবানন, ইতালি, মরিশাস কিংবা দক্ষিণ কোরিয়ায়ও আছেন কয়েক লাখ বাংলাদেশি। মূলত এই দেশগুলো থেকেই বাংলাদেশের প্রবাসী আয় সবচেয়ে বেশি আসে।
বিএমইটির তথ্য বলছে, চাকরি নিয়ে বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে কুমিল্লা। গত দেড় দশকে এ জেলা থেকে ১০ লাখেরও বেশি লোক বিদেশে গেছেন। শীর্ষ দশে থাকা বাকি জেলাগুলো হলো যথাক্রমে চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল, ঢাকা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ ও ফেনী।
বিদেশ থেকে পাঠানো টাকায় চলে এখানকার গ্রামীণ অর্থনীতি। শুধু যে প্রবাসীদের পরিবারগুলোই এ টাকা ব্যবহার করে তা নয়, এখানকার পুরো অর্থনীতিই সচল রাখে এ প্রবাসী আয়। কৃষি হোক, মৎস্য কিংবা ছোট-বড় বেশির ভাগ উদ্যোগের পেছনেই আছে প্রবাসীদের বিনিয়োগ।
৬৪ জেলার মধ্যে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের তালিকার ১১ থেকে ২০-এ আছে যথাক্রমে ল²ীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, মৌলভীবাজার, ফরিদপুর ও হবিগঞ্জ। এর প্রতিটি থেকে গত এক দশকে এক লাখের বেশি লোক বিদেশে গেছেন। তালিকার পরের জেলাগুলো হলো বরিশাল, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, যশোর, বগুড়া, কক্সবাজার, পাবনা, সুনামগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কুষ্টিয়া।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ আয়-ব্যয় খানা জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে দারিদ্র্য কম বা ধনী ১০ জেলা হলো নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, গাজীপুর, ফরিদপুর, ঢাকা, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মৌলভীবাজার ও সিলেট।
বিএমইটির তথ্য অনুসারে, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ছয়-সাত লাখ মানুষ গড়ে বিদেশে যাচ্ছেন। মূলত নির্মাণশ্রমিক, প্লান্টেশন, কৃষি, সার্ভিস বা উৎপাদন খাতে কাজ করেন বাংলাদেশিরা। তবে একটা বিষয় ভীষণ ইতিবাচক। বাংলাদেশিরা খুব দ্রæত কাজ ও ভাষা শিখে যান। এরপর কঠোর পরিশ্রম করে প্রবাসীরা দেশে টাকা পাঠান।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতি গত ৫০ বছরে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। ২০৪১ সালে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে হলে উন্নয়নের এধারা অব্যাহত রাখতে হবে।
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, অবদানের পরও প্রবাসীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়নি, বিমানবন্দর থেকে শুরু করে দূতাবাস সবখানেই পোহাতে হয় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। পাসপোর্ট তৈরি থেকেই এর শুরু। এরপর রিক্রুটিং এজেন্সির দালাল ও প্রতারক এজেন্সি, চাকরির বিষয়ে অসত্য তথ্য, উচ্চমূল্যে ভিসা কেনাবেচা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সরকারি ছাড়পত্র সব ক্ষেত্রে সীমাহীন যন্ত্রণা। দেশের আকাশ পার হলে শুরু হয় বিরূপ প্রকৃতি, অমানুষিক পরিশ্রম, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবনযাপন, মালিকদের প্রতারণা, নির্যাতন। বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসে গেলে কাক্সিক্ষত সেবা মেলে না, দেশে ফিরলেও ভোগান্তি।
পুরোনো এসবের সঙ্গে কোভিড-১৯ সংকট আরো বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের জন্য এই সংকটটা ছিল মূলত তিন ধরনের। প্রথমত, স্বাভাবিক বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রায় বন্ধ। দ্বিতীয়ত, ছুটিতে দেশে এসে করোনার কারণে লকডাউনে আটকে পড়েছে লাখখানেক মানুষ। তৃতীয়ত, কাজ হারিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ প্রবাসী দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন।
এদিকে, সারা বিশ্বেই কৃষিসহ নানা খাতে কর্মীদের চাহিদা বাড়ছে। এ বছরের প্রথম তিন মাসেই এক লাখ লোকের বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে। সরকার এখন নতুন করে আগামী দিনগুলোতে কোনো খাতের লোক যাবে, তাদের দক্ষতা কী হবে এসব প্রস্তুতি এগিয়ে রাখতে পারে। বিশেষ করে নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান জরুরি। পাশাপাশি করোনার কারণে যেসব পেশার চাহিদা বেড়েছে, সেসব পেশায় দক্ষ জনবল তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে।
শরিফুল হাসান আরো বলেন, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয়ের ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবেই। তবে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, এক কোটিরও বেশি প্রবাসী শুধু দেশের অর্থনীতি সচল রাখছেন তা নয়, অনেকদূর থেকেও বুকের মধ্যে যতœ করে রেখেছেন লাল-সবুজের জন্য ভালোবাসা। আর পৃথিবীর প্রতিটি দেশে তারাই তো বাংলাদেশের প্রতিনিধি! এই বাংলাদেশের উন্নতির জন্য লাল-সবুজের পাসপোর্টধারী প্রবাসীদের তাই সম্মান জানাতেই হবে।
বিএসডি/এসআইএস/এমকেএ