বর্তমান সময় ডেস্ক
দরিদ্র পরিবারে জন্ম জেলে আব্দুল গণি গাজীর (৪৫)। অভাবের তাড়নায় লেখাপড়া করা হয়নি। ছোটবেলায় বাবার কাছ থেকে নদীতে মাছ ধরার কৌশল শেখেন। শুরু হয় সংগ্রামী জীবন। সুন্দরবন ও এর আশপাশের নদীতে ঘুরে ঘুরে এখন তিনি পরিচিতি পেয়েছেন ‘টাইগার গণি’ নামে। এই পরিচিতিও এক দিনে হয়নি। বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়েই আব্দুল গণি গাজী এখন টাইগার গণি।
আব্দুল গণি গাজী ওরফে টাইগার গণি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগর ইউনিয়নের কালিঞ্চি গ্রামের মৃত বদরউদ্দীন গাজীর ছেলে। বাঘের মুখ থেকে জীবিত মানুষ অথবা ছিন্নভিন্ন মরদেহ ফিরিয়ে আনার ভয়ংকর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০০৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাঘের মুখ থেকে শতাধিক মানুষকে ছিনিয়ে এনেছেন। আব্দুল গণি থেকে টাইগার গণিতে পরিণত হওয়ার সেই ভয়ংকর পথের গল্প ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছেন আব্দুল গণি গাজী।
যেভাবে পা বাড়ালেন বাঘের সামনে
আব্দুল গণি গাজী বলেন, জ্ঞানবুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই আমি জেলে। সুন্দরবন ও সুন্দরবন উপকূলীয় নদীতে মাছ ধরেই চলে সংসার। তবে সুন্দরবনে গিয়ে যে কোনো জেলে বাওয়ালিদের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তাম সব সময়। এসব করতে গিয়েই ঘটনাক্রমে ২০০৭ সালে সুন্দরবন নিয়ে কাজ করা সংগঠন ওয়াইল্ড টিমে আমার চাকরি হয়। আমার এলাকার ফরেস্ট অফিস থেকে অনুমতিপত্র নিয়ে ৭ সদস্যের একটি দল মধু সংগ্রহ করতে সুন্দরবনে যান। এদের মধ্যে দুইজনকে বাঘে ধরে। একজন জীবিত ফিরলেও আরেকজন বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারান।
মরদেহটি উদ্ধার করতে টাইগার টিমের সদস্য, ফরেস্ট টাইগার রেসকিউ টিমসহ স্থানীয়দের সঙ্গে আমিও ঘটনাস্থলে যাই। আমি সহযোগিতা করেছিলাম সেই মরদেহটি উদ্ধার করতে। ওই দলকে আমি জানালাম কীভাবে মরদেহটি আমরা উদ্ধার করব বা কীভাবে সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করব। এরপর আমার কার্যক্রম পছন্দ হওয়ায় ওয়াইল্ড টিমের ফরেস্ট টাইগার রেসপন্স টিমে চাকরি দিল তারা। এক বছর পর ২০০৮ সালে টিম লিডারের দায়িত্ব দেয় আমাকে। তারপর থেকেই সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে কেউ বিপদগ্রস্ত হলেই আমাকে দায়িত্ব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। ২০১৯ সালে ওয়াইল্ড টিমের ফরেস্ট রেসপন্স টিমের প্রজেক্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় সেই চাকরিটা এখন আর নেই। তবে আমার কার্যক্রম থেমে নেই।
বিপদগ্রস্ত মানুষকে উদ্ধার
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার (২১ ডিসেম্বর) বাঘের আক্রমণে নিহত বনজীবী মুজিবর রহমানের মরদেহটি উদ্ধার করেন আব্দুল গণি গাজী। তিনি বলেন, আগের দিন সন্ধ্যার আগে মুজিবর রহমানকে সুন্দরবনের পায়রাটুনি খাল এলাকায় বাঘে ধরে নিয়ে যায়। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই মরদেহটি উদ্ধার করে ফিরিয়ে দিয়েছি পরিবারটিকে। বাঘটি মুজিবর রহমানের একটি পা পুরোটাই খেয়ে ফেলেছিল। বনের মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে মরদেহটি উলঙ্গ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখি। আশপাশে বাঘের উপস্থিতি থাকতে পারে, চারপাশে একটু নজর দিয়েই মরদেহটি ঘাড়ে তুলে নিয়ে ফিরে আসি নৌকায়। ২০০৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত একশর বেশি মানুষকে উদ্ধার করেছি। এর মধ্যে ৮০-৮৫ জন মৃত। বাকি ১৫-২০ জনকে জীবিত। তবে জীবিত উদ্ধারের বিষয়টি হচ্ছে যখনই কেউ বাঘের আক্রমণের শিকার হন তাৎক্ষণিক তাকে রেসকিউ করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা বা নানাভাবে সহযোগিতা করা। এসবগুলোকে জীবিত উদ্ধার হিসেবে ধরেছি।
বাঘের মুখোমুখি
২০০৯ সালে ডিঙ্গিমারি নামক একটি খাল এলাকায় একজনকে বাঘে ধরে। তাকে উদ্ধার করতে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়েই পড়েছিলাম বাঘের মুখোমুখি। বাঘ ওই মানুষটাকে খেতে খেতে শুধু বুকের পাঁজর আর মাথাটুকু বাকি রেখেছিল। ওই মরদেহ যখন খুঁজছিলাম বনের মধ্যে। সুন্দরবনে গাছের গায়ে থাকা রক্ত, মাংস ও বাঘে টেনে নিয়ে যাওয়ার স্পটগুলো চিহ্নিত করেই মূলত মরদেহ শনাক্তের কাজ করি। ৩-৪ ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পর মরদেহটির সন্ধান পেলাম। আমার থেকে ১০-১২ হাত দূরে ছিল মরদেহটি। হঠাৎ দোয়েল পাখির মতো কী যেন একটা সামনে দিয়ে উড়ে গেল। থমকে দাঁড়ালাম। এক মিনিটের মধ্যেই বাঘ সামনে হাজির। আমার দিকে ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল বাঘটি আর গর্জন করছিল।
বাঘের গর্জন খুব ভয়ানক হয়। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তবে সাহস হারাইনি। বাঘের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মাটিতে গড়াগড়ি শুরু করলাম তখনও বাঘ গর্জন করছিল, অনেক ভয়ানক। আমিও চিৎকার শুরু করলাম। হাতে থাকা লাঠি দিয়ে শব্দ করতে থাকলাম। কয়েকবার শব্দ করতেই বাঘের গর্জন থেমে গেল। বাঘটি চলে গেল। মরদেহের অবশিষ্ট থাকা বুকের পাঁজর ও মাথাটুকু নিয়ে দ্রুত নৌকায় ফিরলাম। এটা একটা ভয়ানক ঘটনা ছিল আমার জীবনে। যা আমি আজও ভুলিনি।
উদ্ধার কাজে গিয়ে ভয়
সুন্দরবনের মধ্যে অনিশ্চিত যাত্রায় বাঘের মুখ থেকে মানুষকে উদ্ধার কাজ করতে গিয়ে ভয় লাগাটাই স্বাভাবিক ঘটনা। আমারও ভয় লাগে তবে কাউকে বুঝতে দেই না। আমি টিম লিডার হয়ে যদি ভয়ে থাকি তবে বাকি সদস্যরা ভয়ানক এই উদ্ধার কাজ করতে সাহস হারাবে।
আব্দুল গণি থেকে টাইগার গণি পরিচিতি যেভাবে
সুন্দরবনের মধ্যে বাঘের আক্রমণে হতাহতদের উদ্ধারে কাজ করতে গিয়ে এলাকায় টাইগার গণি নামে পরিচিতি পেয়ে গেছি। এলাকার মানুষ আমাকে খুব ভালোবাসে। এ অঞ্চলের যে কারো বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান হলে আমাকে দাওয়াত দেন। সবাই সালাম দেন, কুশল বিনিময় করেন। রাস্তায় বের হলেই বুঝতে পারি মানুষ কতটা ভালোবাসে। এভাবেই মানুষদের ভালোবাসা নিয়েই থাকতে চাই। সবাই ভালোবেসে আমাকে টাইগার গণি নামেই ডাকেন আর আমিও সাড়া দেই।
পরিবার চলছে যেভাবে
আব্দুল গণি গাজী বলেন, ১৯৯৮ সালে বাবা বদরউদ্দীন গাজী মারা গেছেন। মা আমেনা বেগম মারা গেছেন ২০২০ সালে। পরিবারে এখন আমিসহ স্ত্রী শাহিদা বেগম, ছেলে শাহিনুর আলম ও মানসিক ভারসম্যহীন খাদিজা খাতুন নামে আমার বড় বোন রয়েছে। মেয়ে মুক্তা খাতুনকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। ছেলে শাহিনুর আলম এইচএসসি পাস করেছে। এরপর অভাবের তাড়নায় আর লেখাপড়া করাতে পারিনি। বর্তমানে আমি নিজেও বেকার। সুন্দরবনে স্বেচ্ছাসেবক হয়েই বিপদগ্রস্ত মানুষ ও তার পরিবারের পাশে ছুটে যাই।
আব্দুল গণি গাজী ওরফে টাইগার গণি মানুষের বিপদে আপদে সহযোগিতা করেন বলে জানান রমজাননগর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সোহরাব আলী। তিনি বলেন, সুন্দরবনে মানুষদের বাঘে ধরলে বা বিপদে পড়লে সহযোগিতা করেন গণি। এটা করতে করতে এখন এলাকায় সবাই তাকে টাইগার গণি নামেই ডাকে। এলাকায় এখন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন তিনি।
সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের কর্মকর্তা এমএ হাসান জানান, আব্দুল গণি গাজী বেসরকারি সংস্থা ওয়াইল্ড টিমের সঙ্গে কাজ করতেন। সুন্দরবনে কাউকে বাঘে ধরলে তাকে উদ্ধার করেন। ওয়াইল্ড টিম থেকে তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল কীভাবে বাঘে ধরলে উদ্ধার করতে হয়। আমাদের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। তবে দুই দিন আগে বাঘের আক্রমণে নিহত মুজিবরকে উদ্ধার অভিযানে আব্দুল গণি অংশ নিয়েছিলেন। অনেক ভালো কাজ করছেন তিনি। সুন্দরবনে বাঘে ধরা মানুষকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এলাকায় টাইগার গণি নামে তিনি পরিচিত পেয়েছেন।
এসএ