সুয়েজ খালে আড়াআড়ি পথ আটকে রাখা দৈত্যাকার এক জাহাজ সরানো নিয়ে সম্প্রতি ট্রল হয়েছে প্রচুর। তবে এতে যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, সেটি মোটেও মশকরা নয়। এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে চলাচলের প্রধান বিকল্প পথ এটি। এই খাল দিয়েই বৈশ্বিক বাণিজ্যের প্রায় ১২ শতাংশ সম্পন্ন হয়।
সামুদ্রিক বাণিজ্য নির্ভর করছে এমন সরু পথগুলোর মধ্যে একটি সুয়েজ খাল। বাকিগুলোর মধ্যে আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরকে যুক্ত করা পানামা খাল, পারস্য উপসাগর ও ওমান উপসাগরকে যুক্ত করা হরমুজ প্রণালীর কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের সমান কোনও জাহাজ আটকে যাওয়ার আগে থেকেই চাপের মুখে ছিল এসব গুরুত্বপূর্ণ পথ। করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর আগপর্যন্ত সামুদ্রিক বাণিজ্য ক্রমাগত বাড়তে থাকা এর অন্যতম কারণ।
২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপথে কার্গো পরিবহন হয়েছিল ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন টন। ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ১ বিলিয়ন টনে।
চ্যাথাম হাউস নামে একটি থিংক ট্যাংকের হিসাবে, ২০০০ সালে বৈশ্বিক শস্য রফতানির ৪২ শতাংশই অন্তত একটি সরু সামুদ্রিক পথ পাড়ি দিত। ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫ শতাংশে। এরপর বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়ায় সরু পথগুলোর চাপ আরও বেড়েছে নিশ্চিত।
চাপের মুখে কিছু পথ অবশ্য নিজের সক্ষমতা বাড়িয়েছে। ২০১৫ সালে আট বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে সুয়েজ খাল সম্প্রসারণ প্রকল্পের মাধ্যমে ৩৫ কিলোমিটার নতুন চ্যানেল তৈরি এবং বিদ্যমান অংশের ড্রেজিং করা হয়। এর ফলে সেখানে আগের চেয়ে বড় জাহাজ চলাচলের সুযোগ পায়।
এর এক বছর পরেই পানামা খাল সম্প্রসারণের কাজ শেষ হয়। এর মাধ্যমে সেটি বিশ্বের ৭৯ শতাংশ কার্গোবাহী জাহাজ চলাচলের উপযোগী হয়ে ওঠে। সম্প্রসারণের আগে এর হার ছিল মাত্র ৪৫ শতাংশ।
বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের সরু পথগুলোর ওপর চাপ কমানোর সবচেয়ে কার্যকর সমাধান হতে পারে নতুন বাইপাস তৈরি। তেলের মতো পণ্য পরিবহনে জাহাজের বদলে পাইপলাইনও কাজে লাগানো যেতে পারে। যেমনটা হচ্ছে লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগরের মধ্যে সুমেদ পাইপলাইন দিয়ে। তবে মাটির ওপর দিয়ে সব পণ্য পরিবহন এতটা সহজ নয়।
রাশিয়া অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলিয়ে এশিয়া-ইউরোপের মধ্যে আরেকটি বিকল্প বাণিজ্যিক রুট তৈরি করতে চায়। তবে বছরে মাত্র তিন-চার মাস চলাচলের মৌসুম এবং বরফের অনিশ্চিত অবস্থার কারণে সেটি এখনও বাস্তবতার মুখ দেখেনি।
এছাড়া, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেও এসব পথের বিকল্প খোঁজা জরুরি হয়ে পড়েছে। ২০১৯ সালে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা একটি সৌদি জাহাজ আটক করে, যেটি দক্ষিণ কোরিয়ার অয়েল-ড্রিলিং রিগ টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। ইয়েমেন উপকূল সরু বাব আল-মান্দেব প্রণালীতে অবস্থিত, যেখান দিয়ে বিশ্বের ১০ শতাংশ পেট্রোলিয়াম পরিবহন হয়ে থাকে।
এতে হানা দিচ্ছে সোমালিয়ার জলদস্যুরাও। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জাহাজ ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে সোমালিয়া বা ইন্দোনেশিয়া উপকূলে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অ্যান্টার্কটিকা দিয়ে পণ্য পরিবহন হয়তো একদিন ঠিকই বাস্তবে পরিণত হবে, তবে এটি সরু পথগুলোকে অন্যদিক থেকে ঝুঁকিতে ফেলছে। এর প্রভাবে দুর্যোগের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। ২০১৬ সালের এক চরম শুষ্ক মৌসুমে পানামা খাল দিয়ে প্রথমবারের মতো কিছু বড় জাহাজ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিতে হয়েছিল। আর সামুদ্রিক উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বন্দরের ব্যবহারযোগ্যতাও হুমকির মুখে।
অনেকে হয়তো ভাবেননি, মাত্র একটি জাহাজের কারণে সুয়েজ খালের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক পথ টানা এক সপ্তাহ বন্ধ থাকবে। তবে বিশাল এই জাহাজটি ঠিকই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা কতটা ভঙ্গুর। এবারে হয়তো ক্রেন, ডিগার আর টাগবোট দিয়ে বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া গেছে, তবে ভবিষ্যতে সেটি আর না-ও হতে পারে। এজন্য সরকার এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখনই সরু পথের বিকল্প নিয়ে পরিকল্পনা শুরু করতে হবে।
সূত্র; দ্য ইকোনমিস্ট