বিংশ শতাব্দীর বিস্ময়কর সাহিত্য প্রতিভা কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী কবিদের মধ্যে অন্যতম; যিনি বাংলা সাহিত্যের প্রায় সবগুলো ধারাকে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং নতুন মাত্রায় পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনিই প্রথম সর্বমানবিক মানসের প্রয়াস, প্রয়োগ ও প্রকাশ ঘটিয়েছেন বাংলা সাহিত্যে তথা তাঁর কবিতায়, গানে, গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে, প্রবন্ধে, চিঠিপত্রে ও অভিভাষণে তিনি সাধারণ মানুষের জয়গান গেয়েছেন; নিপুণ হাতে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁদের সুখ-দুঃখ, বেদনা-হাহাকারের করুণ চিত্র।
তিনি লিখেছেন- গাহি সাম্যের গান/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান/যেখানে মিশেছে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম খ্রিস্টান /গাহি সাম্যের গান।” সাম্যের গান রচয়িতা নজরুল, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবি নজরুল, ধূমকেতুর কবি নজরুল, সুরের কবি নজরুল, বিদ্রোহী কবি নজরুল আমাদের প্রিয় কবি। কেননা নজরুলের ব্যক্তিত্বকে, মানুষ নজরুলকে, প্রেমিক নজরুলকে, কবি নজরুলকে, সঙ্গীতজ্ঞ নজরুলকে হিন্দু-মুসলমানের মিলন মৈত্রীর কবি নজরুলকে বাঙালি কোনদিন ভুলবে না।
কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালের ২৫ মে, বাংলা ১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ বঙ্গাব্দে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতামহ কাজী আমিন উল্লাহর পুত্র কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয়স্ত্রী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান তিনি। তার বাবা ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মাজারের খাদেম। নজরুলের তিন ভাইয়ের মধ্যে কনিষ্ঠ কাজী আলী হোসেন এবং দুই বোনের মধ্যে সবার বড়কাজী সাহেবজান ও কনিষ্ঠ উম্মে কুলসুম। কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। নজরুল গ্রামের স্থানীয়মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেন। এছাড়া মক্তবে কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত¡ অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯০৮ সালে তার পিতার মৃত্যু হয়, তখন তার বয়স মাত্র নয় বছর। পিতার মৃত্যুর পর পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তার শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্থ হয় এবং মাত্র দশ বছর বয়সে জীবিকা অর্জনের জন্য কাজে নামতে হয়তাকে। এসময় নজরুল মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায়উত্তীর্ণ হয়ে উক্ত মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন।
একই সাথে হাজি পালোয়ানের কবরের সেবক এবং মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজ শুরু করেন। এইসব কাজের মাধ্যমে তিনি অল্প বয়সেই ইসলামের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পান যা পরবর্তীকালে তার সাহিত্যকর্মে বিপুলভাবে প্রতিফলিত হয়। তিনিই বাংলা সাহিত্যে ইসলামী চেতনার চর্চা শুরু করেছেন বলা যায়। বাল্য বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একটি লেটো নাট্যদলে যোগ দেন। তার চাচা কাজী বজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট উস্তাদ ছিলেন এবং আরবী, ফার্সী ও উর্দূ ভাষায় তার দখল ছিল। এছাড়া বজলে করিম মিশ্র ভাষায় গান রচনা করতেন। এছাড়া ঐ অঞ্চলের জনপ্রিয় লেটো কবি শেখ চকোর এবং কবিয়াল বাসুদেবের লেটো ও কবিগানের আসরে নজরুল নিয়মিত অংশ নিতেন। লেটো দলেই তার সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। এই দলের সাথে তিনি বিভিন্ন স্থানে যেতেন, তাদের সাথে অভিনয় শিখতেন এবং তাদের নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন। নিজ কর্ম এবং অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বাংলা এবং সংস্কৃত সাহিত্য অধ্যয়ন শুরু করেন। সেই অল্প বয়সেই তার নাট্যদলের জন্য বেশকিছু লোকসঙ্গীত রচনা করেন।
বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে তার বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তনে তাকে এই উপাধি প্রদান করা হয়। ১৯৭৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যেরও অবনতি হতে শুরু করে। জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশে তার মৃত্যু উপলক্ষে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালিত হয়। তার জানাজায় ১০ হাজারেরও অধিক মানুষ অংশ নেয়। নজরুল তার একটি গানে লিখেছিলেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই / যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই’, কবির এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী তার সমাধি রচিত হয়।
বিএসডি/জেজে