নিজস্ব প্রতিবেদক,
জীবজগতের বৃহত্তম স্থলচর স্তন্যপায়ী প্রাণী হাতি। দেশে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে হাতির অন্যতম অভয়ারণ্য ছিল মধুরছড়া, বালুখালী, পালংখালী, শফিউল্লাহকাটা, জামতলা, বাঘঘোনা, কারাংখালী, উনসিপ্রাং। কিন্ত এসব অঞ্চলে বন ও পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন করেছে রোহিঙ্গারা। এতে হুমকির মুখে পড়েছে বুনো হাতি।
আজ ১২ আগস্ট। বিশ্ব হাতি দিবস। প্রতি বছর ১২ আগস্ট সারাবিশ্বে হাতি দিবস হিসেবে পালন করা হয়। হাতি দিবসে এ বন্য প্রাণীকে সংরক্ষণের ওপর বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছে।
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন পাহাড়ের বনাঞ্চল কেটে বসতি স্থাপন করছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। উখিয়া-টেকনাফ উপজেলায় ৬ হাজার একর বনভূমি, হাতির আবাসস্থল ও চলাচল পথ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে হাতি চলাচলের করিডোর হিসেবে পরিচিত টেকনাফ-উখিয়া-নাইক্ষ্যংছড়ি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে এসব বসতি স্থাপন করতে গিয়ে তারা পাহাড় ও গাছ কাটার পাশাপাশি বন্ধ করে দিয়েছে বন্য হাতি চলাচলের করিডোর।
উখিয়ার কুতুপাংল থেকে বালুখালী ক্যাম্প পর্যন্ত এলাকায় হাতি চলাচলের পথে ‘সাবধান, বন্যহাতি চলাচলের পথ’ লেখা সাইন বোর্ড লাগানো থাকলেও নেই সচেতনতা। এসব সাইন বোর্ডের পাশে অসংখ্য ঝুঁপড়ি ঘর তৈরি করে বসবাস করছে রোহিঙ্গারা।
গত ২৭ জুন টেকনাফ সীমান্তে দুটি বুনো হাতি খাবার সংকটে পড়ে বন থেকে বেরিয়ে নাফ নদীর প্যারাবনে ছোটাছুটি করেছিল। এর দুই দিনের মাথায় ২৯ জুন আবারও টেকনাফের শাহপরীর ঘোলারচরে দুটি হাতির দেখা মেলে।
বন্য প্রাণী গবেষক তথা পরিবেশকর্মীরাও এটা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, হাতির চলাচল ও আবাসস্থল দখলে নিয়ে বসতি স্থাপন করলে হাতি লোকালয়ে ঢুকে পড়বে। মানুষের ঘরবাড়ি ও গাছ গাছালির ক্ষতি করবে। এমনকি হাতির আক্রমণে প্রাণহানি ঘটতে পারে।
গবেষকরা জানান, বিভিন্ন বাধা বিপত্তির জন্য হাতি চলাচল করতে না পারলে, নির্দিষ্ট একটা বিচরণ ক্ষেত্রে আবদ্ধ হয়ে পড়বে। এর ফলে এই প্রাণীগুলোর আচরণে পরিবর্তন আসবে। প্রজনন বাধাগ্রস্ত হবে। দীর্ঘদিন এভাবে প্রজনন থেকে বিরত থাকলে আগামীতে হাতির বিলুপ্তি ঘটবে।
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা দীপু বলেন, ‘বন্য হাতি বনে থাকবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এদের আবাসস্থল নষ্ট করে সেখানে মানুষের বসতি স্থাপন হাতির জন্য বিরাট হুমকির ব্যাপার। বনের ফলমূল ও গাছপালার ভিড়ে বন্যপ্রাণী নিরাপদে থাকে। দিনের পর দিন বন উজাড় করলে হাতি তো লোকালয়ে ঢুকে পড়বেই। এরা বনে গাছপালা কেটে বসতি স্থাপন করলে হাতিগুলো খাবার সংকট ও নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়। যার ফলে হাতি লোকালয়ে ঢুকে পড়ে।
তিনি বলেন, ‘২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে উখিয়া ও টেকনাফের অন্তত ১০ হাজার একর বনভূমি ধ্বংস করে আশ্রয় নিয়েছে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। এ কারণে বনাঞ্চলে হাতিগুলোর পরিবেশ, আবাসস্থল ধ্বংস হয়েছে। বন্য হাতির জীবন সংকটে পড়েছে। এই অবস্থায় হাতিদের যে আবাসস্থল রয়েছে, তা নিরাপদ রাখতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তাসহ নানাভাবে হাতির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।’
সেইভ দ্য নেচার অব বাংলাদেশ এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম রিয়াদ বলেন, ‘এক সময় হাতির অন্যতম অভয়ারণ্য ছিল মধুরছড়া, বালুখালী, পালংখালী, শফিউল্লাহকাটা, জামতলা, বাঘঘোনা, কারাংখালী, উনসিপ্রাং। এখন তাদের সেই চলার পথে রোহিঙ্গা বসতি। এসব অঞ্চলের ৬৮টি হাতি এখন দুই ভাগ হয়ে গেছে। প্রায় ৪০টি আছে দক্ষিণ টেকনাফ অঞ্চলে, বাকিগুলো হিমছড়ি বনাঞ্চলের আশপাশে।’
তিনি জানান, রোহিঙ্গারা আসার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৩ জন নিহত হয়েছে বন্য হাতি আক্রমণে।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. হুমায়ূন কবির বলেন, ‘কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত দক্ষিণ বন বিভাগের আওতাধীন বনাঞ্চলে গত এক বছরে এক বছর বয়সী প্রায় ১৬টি বাচ্চা দেখা গেছে। হিমছড়ি, ধোয়াপালং, পানেরছড়া, ইনানী, হোয়াইক্যং, শীলখালী রেঞ্জের বনাঞ্চলে এসব বাচ্চা প্রসব করে মা হাতি। এসব হাতি এশিয়ান প্রজাতির।’
হুমায়ুন কবির আরও বলেন, ‘২০১৭ সালের সর্বশেষ জরিপে কক্সবাজার দক্ষিণ বনাঞ্চলে মোট এশিয়ান হাতির সংখ্যা ছিল ৬৩টি। এসব হাতি থেকে প্রজনন বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে ২৬৮টি মহাবিপন্ন এশিয়ান হাতির দুই-তৃতীয়াংশের বাস কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে। কিন্তু কক্সবাজার ও পার্শ্ববর্তী বনাঞ্চলে বসতি, রেললাইন, বিভিন্ন প্রকল্প, অবৈধ দখলসহ বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে হাতির আবাসস্থল উজাড় করা হয়।
এদিকে, ফসলসহ বাগান রক্ষার্থে এসব হাতিকে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে ও গুলি করে হাতিকে হত্যা করা হয়েছে। গত তিন বছরে কক্সবাজার দক্ষিণ ও উত্তর বনাঞ্চলে ১৮টি বন্য হাতির মৃত্যু হয়।
পরিবেশবিদরা বলছেন, ‘বনাঞ্চল ধ্বংস করে রোহিঙ্গা বসতির কারণে বন্যপ্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন্য হাতি। রোহিঙ্গাদের জন্য হাতির করিডোর বন্ধ হয়ে গেছে। যদি রোহিঙ্গা প্রত্যাবসন করে জায়গাটি ফেরত পাওয়া যায় তবে উন্নয়ন করে করিডোর পুনরায় ফেরানো সম্ভব।
বিএসডি/আইপি