গুলিস্তান এলাকার অঘোষিত সম্রাট। ফুটপাত থেকে মার্কেট- সর্বত্র একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ তার। বলছি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদউদ্দিন আহমেদ রতনের কথা। তার নাম ফরিদউদ্দিন আহমেদ রতন হলেও ‘ম্যাজিক রতন’ হিসেবেই গণমাধ্যমে নাম উঠে এসেছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ, মার্কেটের দোকানদারসহ জনসাধারণের বিস্তর অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। গুলিস্তান, সেগুনবাগিচা, নগর ভবনসহ আশপাশের এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য রতনের।
গুলিস্তান এলাকার গুরুত্বপূর্ণ চারটি মার্কেটে একক নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারও দখলে রেখেছেন দীর্ঘদিন ধরে। গণপূর্ত, বিদ্যুৎ ভবন ও নগর ভবনের বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজেও একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। সর্বশেষ দক্ষিণ সিটির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের নাম ভাঙিয়ে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে রতনের বিরুদ্ধে। এর জেরে রতনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন মেয়র ব্যারিস্টার তাপস। এ ঘটনায় তাকে ঘিরে নতুন করে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে।
২০১৫ সালে ডিএসসিসির নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে প্রথমবার জয়ী হলেও নগর ভবনে খুব একটা প্রভাব ছিল না কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন আহমেদ রতনের। গুলিস্তান ও মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবকেন্দ্রিক প্রভাব থাকলেও নগর ভবনে ছিলেন অনেকটা নির্জীব।
ডিএসসিসিতে প্রভাব বিস্তার করতে এক অনুষ্ঠানের ব্যানারে নিজের নাম না দেখে সংস্থাটির দুই কর্মকর্তার গায়ে হাত তোলেন এ ওয়ার্ড কাউন্সিলর। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) অফিস আঙিনায় তিনি এ কাণ্ড ঘটান। তবে এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। এ ঘটনার পর ধীরে ধীরে নিজের অবস্থান পোক্ত করে নেন রতন। একদিন পর পর নগর ভবনে একাধিক দেহরক্ষী বেষ্টিত হয়ে মহড়া দেন। গ্রেপ্তারের আগে গণপূর্তের ঠিকাদার জিকে শামীম, ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, খালেদ মাহমুদ ভুইয়া চলতেন গাড়ি বহর নিয়ে। তাদের মতো রতনও চলেন গাড়ির বহর নিয়ে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগে বিভেদের সুযোগে ডিএসসিসির সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের কাছের লোক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।সেগুনবাগিচা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান রতনের উত্থান বিস্ময়ের। তারা রতনকে ম্যাজিক ম্যান বলেও সম্বোধন করেন।
নিজ জেলা ফেনীর বাসিন্দা ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ‘দ্য বিল্ডার্স লিমিটেড’-এর মালিক স্বপনের প্রতিষ্ঠানের নামে একে একে ঠিকাদারি কাজ শুরু করেন ফরিদ আহমেদ রতন। সিটি করপোরেশনের নিয়ম অনুসারে কোনো কাউন্সিলর ঠিকাদারি কাজে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। এর পর ‘অর্পি ইঞ্জিনিয়ার্স’ নামে রতনের ভাই শাহজালাল রিপনের নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গড়ে কাজ শুরু করেন। ফোর ইউনিয়ন প্রকল্পে ব্রিজ নির্মাণ, ওসমানী উদ্যানে গোস্যা পার্ক, চানখাঁরপুল মার্কেটসহ কয়েকশ কোটি টাকার কাজ তিনি নামে-বেনামে করেন। তবে এসব কোনো কাজই নির্দিষ্ট মেয়াদে শেষ করতে পারেননি। দফায় দফায় বাজেট ও সময় বাড়ানো হয়েছে।
কাউন্সিলর রতন বেশি সমালোচনায় এসেছে সেগুনবাগিচায় ডিএসসিসিরি একটি ৫ তলা ভবনের তিনটি ফ্লোর নিজের দখলে রেখে। গত ৬ বছরেও ডিএসসিসি এ ভবনে দখলে যেতে পারেনি। এ ছাড়া রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় ডিএসসিসির গুলিস্তান ট্রেড সেন্টার (পুরানবাজার), সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেট, আদর্শ মার্কেট বিকল্প ও মহানগর মার্কেট বিকল্প দখলে রেখেছেন। এসব মার্কেটে ১ হাজার ১৬৯টি নকশাবহির্ভূত দোকান নির্মাণ করে অবৈধভাবে ১৭৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে ডিএসসিসির মেয়রের দপ্তরে।
সর্বশেষ ডিএসসিসি নির্বাচনে মেয়র পদে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস নির্বাচিত হলে তার নাম ভাঙিয়ে দোকানদারদের থেকে তোলা হয় প্রায় পঞ্চাশ কোটি টাকা। আমাদের সময়ের সঙ্গে আলাপকালে বিভিন্ন মার্কেটের অন্তত দশজন ব্যবসায়ী দাবি করেছেন, অবৈধ দোকান বৈধ করে দেওয়ার জন্য মেয়র তাপসের নামে তিনি দোকানভেদে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা করে নিয়েছেন।
তবে ডিএসসিসির মেয়রের দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, মেয়র ব্যারিস্টার তাপস এ বিষয়ে কিছুই জানতেন না। বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত বিষয়ে ফরিদউদ্দিন রতনকে শোকজ করা হয়েছে।
ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস স্বাক্ষরিত এক পত্রে বলা হয় পুরানবাজার হকার্স মার্কেট/পোড়া মার্কেটসহ কয়েকটি মার্কেটে বর্তমান মেয়রের নাম ব্যবহার করে দোকান বরাদ্দ পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ গ্রহণ করেছেন। বিষয়টি স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯-এর ধারা ১৩-এর উপধারা (১) (ঘ) অনুযায়ী অসদাচরণ। এতে ডিএসসিসির ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে। আপনার এ ধরনের কার্যকলাপের কারণে আপনার বিরুদ্ধে কেন স্থানীয় সরকার আইন ২০০৯-এর ধারা ১৩ মতে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে না তার জবাব পত্রপ্রাপ্তির ৭ কার্যদিবসের মধ্যে নিম্নস্বাক্ষরকারীর দপ্তরে দাখিল করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২৯ অক্টোবর পুরানবাজার হকার্স সমিতি (গুলিস্তান ট্রেড সেন্টার) মার্কেটের অব্যবস্থার বিষয়ে ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন। সেখানে তারা অভিযোগ করেন, গুলিস্তান ট্রেড সেন্টার মার্কেটটি পুনর্নির্মাণের জন্য ২০১৮ সালে দরপত্র আহ্বান করে ডিএসসিসি। ১৯ অক্টোবর ওই মার্কেট নির্মাণের কার্যাদেশ দেয়। আর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ পায় অর্পি ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড। এ প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী শাহজালাল রিপন। তিনি ডিএসসিসির ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদউদ্দিন আহমেদ রতনের ভাই ।
লিখিত অভিযোগে তারা বলেছেন, ডিএসসিসির অনুমোদিত নকশা পরিবর্তন করে দোকানের আকার ছোট করে দোকান সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। এ মার্কেটের প্রতিটি ফ্লোরের টয়লেট, লিফট, আলো-বাতাস প্রবেশের জন্য নির্ধারিত জায়গায় অতিরিক্ত দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। বলা হয়, ডিএসসিসির অনুমোদিত নকশায় প্রথম তলা থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত ১ হাজার ৬৪৬টি দোকান নির্মাণ করার কথা থাকলেও অতিরিক্ত ৪০০ দোকান নির্মাণ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া অবৈধভাবে নির্মিত দোকানগুলোর মধ্যে ২০০টি দোকান মেয়র কোটার দাবি করে সেসব দোকান বিক্রি করে অন্তত ১৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর রতন।
গুলিস্তান পুরানবাজার হকার্স সমিতির নেতারা লিখিত অভিযোগে জানান, গুলিস্তান পুরানবাজার বা গুলিস্তান ট্রেড সেন্টারের প্রথম তলা, দ্বিতীয় তলার দোকানের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ায় ১৫০ থেকে ২০০টি দোকান ডিএসসিসির অনুমোদন ছাড়াই বিভিন্ন জনের কাছে ভাড়া দিয়ে দোকানপ্রতি বার্ষিক দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা আদায় করছে। এসব দোকান ভাড়া দিয়ে একই সিন্ডিকেট বছরে অন্তত সাড়ে ৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
এ ছাড়া গুলিস্তান সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেটে ৬৬৯টি নকশাবহির্ভূত দোকান নির্মাণ করে ঢাকা দক্ষিণের ২০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন বিক্রি করেছেন বলে ডিএসসিসির কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। তিনি কাউন্সিলর ফরিদউদ্দিন আহমেদ রতনের ঘনিষ্ঠ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গুলিস্তান আদর্শ মার্কেটে (বিকল্প) শতাধিক নকশাবহির্ভূত দোকান নির্মাণ করে বিক্রি করেছেন কাউন্সিলর রতন ও যুবলীগ নেতা শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন চক্রটি। এ মার্কেটের উন্মুক্ত জায়গা, সিঁড়ি, সমিতির অফিসের জায়গা এবং ছাদে অবৈধভাবে এসব দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে এসব অনিয়ম ও দখলদারত্ব চললেও ডিএসসিসি কোনো প্রতিকার করতে পারছে না।
পুলিশের মহাপরিদর্শক বরাবর করা এক অভিযোগেও তুলে ধরা হয়েছে কাউন্সিলর রতনের অপকর্মের খতিয়ান। সেখানেও মার্কেট দখলসহ নানা অপকর্ম থেকে রক্ষা পেতে আকুতি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
জানা যায়, কাউন্সিলর রতন সেগুনবাগিচা এলাকায় ফুটপাতের ওপর একটি পাকা স্থাপনা নির্মাণ করেছেন। সেগুনবাগিচায় আগোরা সুপার শপের উল্টোপাশে ফুটপাতের ওপর স্থায়ীভাবে এটি নির্মাণ করছেন। এখানে বর্তমানে একটি গ্যারেজ ও মনিহারি দোকান রয়েছে। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে করপোরেশনের জায়গা দখল করে গড়ে তুলেছিলেন মার্কেট। পরে মেয়র তাপসের হস্তক্ষেপে তা ভাঙা হয়। একইভাবে গুলিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় তিনি অবৈধভাবে দোকান নির্মাণ করেছেন।
জানা যায়, রতন কেবল সিটি করপোরেশনেই কাজ করেন না। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি (পিজিসি) একচ্ছত্র আধিপত্য তার। একই রকম প্রভাব রয়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তরে। এসব দপ্তরে তিনি একাধিক গানম্যান নিয়ে প্রবেশ করেন। যদিও গণপূর্তে তিনি নিজ নামে কাজ করেন না, কাজ করেন তার ভাই শাহজালাল রিপনের নামে। বিজয়নগরের আল রাজি টাওয়ারে রতনের রয়েছে বিলাসবহুল অফিস। এর বাইরে সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারেও তার এক ফ্লোরজুড়ে অফিস রয়েছে।
কাউন্সিলর হওয়ার আগে থেকেই গুলিস্তানের ফুটপাতে চাঁদাবাজির অভিযোগ ছিল রতনের বিরুদ্ধে। ইউনিট আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা জানান, রতনের লোকজনের বাইরে এই এলাকায় কিছুই হয় না। পুরো গুলিস্তান এলাকা তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে। অন্তত ৯টি স্পট থেকে প্রতিদিন তার নিজস্ব লোক বলে পরিচিতরা টাকা আদায় করেন। বিভিন্ন সময় ডিএসসিসি মেয়র ফুটপাত উচ্ছেদের কথা বললেও গুলিস্তান থেকে কখনই ফুটপাত উচ্ছেদ হয়নি কাউন্সিলরের কারণে।
এ বিষয়ে কাউন্সিলর ফরিদউদ্দিন রতন বলেন, আমি নিয়মের বাইরে কোনো কাজ করি না। কোনো মার্কেটের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা নেই। স্থানীয় কাউন্সিলর হিসেবে কয়েকটি মার্কেটে অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। তাই একটি বিশেষ সিন্ডিকেট আমার বিরুদ্ধে লেগেছে। তারা চাচ্ছে না আমি রাজনীতিতে থাকি। নানা ধরনের প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে তারা।
নোটিশের বিষয়ে তিনি বলেন, এখনো নোটিশ পাইনি। নোটিশ দেখে বলতে পারব আমার বিরুদ্ধে কী ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এর পর জবাব দেব। তবে আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ ভিত্তিহীন। ষড়যন্ত্রমূলক।