বিদেশে অবস্থানরত মেয়ে দেশে ফেরার পর সদ্য প্রয়াত সাংবাদিক, গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের দাফন হবে। সৈয়দ আবুল মকসুদের পারিবারিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মারা যান আবুল মকসুদ।
মঙ্গলবার বিকেলে বাসায় সৈয়দ আবুল মকসুদের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। একপর্যায়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। ওই অবস্থায় তাঁকে দ্রুত পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সন্ধ্যা সোয়া সাতটার দিকে তাঁকে মৃত ঘোষণা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। তিনি স্ত্রী সুলতানা মকসুদ, ছেলে সৈয়দ নাসিফ মকসুদ ও মেয়ে জিহাদ মকসুদসহ অসংখ্য স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। ধানমন্ডির মসজিদে তাকওয়ায় রাত ১০টার দিকে সৈয়দ আবুল মকসুদের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
সৈয়দ আবুল মকসুদের ছেলে সৈয়দ নাসিফ মকসুদ বলেন, তাঁর বোন এ মুহূর্তে ভারতে অবস্থান করছেন। তিনি দেশে ফিরছেন। তাঁর ফেরার পর সৈয়দ আবুল মকসুদের দাফনসহ অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সৈয়দ আবুল মকসুদের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। গতকাল রাতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী আলাদা শোকবার্তায় সৈয়দ আবুল মকসুদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন।
সৈয়দ আবুল মকসুদের মৃত্যুতে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন ও সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান শোক প্রকাশ করেন।
এ ছাড়া শোক প্রকাশ করেছে বিএনপি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), গণফোরাম, বাসদ, গণসংহতি আন্দোলন, ঐক্য ন্যাপ ও সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন।
জীবন ও সংগ্রাম
দেশের প্রগতিশীল চিন্তা, গবেষণা ও আন্দোলনের অন্যতম এই অগ্রগামী ব্যক্তিত্বের জন্ম ১৯৪৬ সালের ২৩ অক্টোবর মানিকগঞ্জে। পেশাগত জীবনে তিনি দীর্ঘ সময় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) কাজ করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে সৈয়দ আবুল মকসুদ সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। পরে বার্লিনের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম থেকে সাংবাদিকতা বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন। চাকরিজীবনে সর্বশেষ ছিলেন বাসসের উপবার্তা সম্পাদক।
২০০৪ সালের ১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার প্রতিবাদে সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রথম আলোতে ‘হুমায়ুন আজাদের ওপর আঘাত, ফ্যাসিবাদের নগ্নরূপ’ শিরোনামে একটি কলাম লেখেন। এরপর তাঁর কর্মস্থল বাসস কর্তৃপক্ষ ও তৎকালীন তথ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায় থেকে তাঁকে কলাম না লেখার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে ৩ মার্চ তিনি বাসস থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর থেকে নিয়মিত প্রথম আলোতে তিনি মতামত লিখতেন। প্রথমা প্রকাশনের সঙ্গেও সৈয়দ আবুল মকসুদ ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ ২০০৪ সালের শেষের দিকে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক সুপ্রভাত-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা’ বইটির জন্য ২০১৭ সালে ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা পুরস্কার’ পান। এর আগে ১৯৯৫ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন।
২০০৩ সালের ১৯ মার্চ ইরাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর প্রতিবাদ হিসেবে সৈয়দ আবুল মকসুদ পশ্চিমা পোশাক ত্যাগ করেন। গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রতি অনুরক্ত এই সামাজিক ও পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী সুতির সাদা কাপড়কে প্রতিবাদের পোশাক হিসেবে বেছে নেন। রাজপথে নানা গণমুখী প্রতিবাদ ও আন্দোলনে তিনি সম্পৃক্ত হতেন। সৈয়দ আবুল মকসুদ বাংলাদেশের পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহসভাপতি ছিলেন। সুন্দরবন রক্ষা, নদী ও দূষণবিরোধী আন্দোলনে তিনি সামনের সারিতে থাকতেন। দেশের খনিজ সম্পদ রক্ষার আন্দোলন তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ–বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য হিসেবে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল ও উপকূল রক্ষার আন্দোলনে তিনি অংশ নেন। এ ছাড়া নিরাপদ সড়ক আন্দোলনসহ নানা সামাজিক আন্দোলনে তিনি যুক্ত ছিলেন।
গবেষণা ও গ্রন্থ
সাংবাদিকতা ও সামাজিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের পাশাপাশি সৈয়দ আবুল মকসুদ নিয়ত গবেষণায় রত ছিলেন। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি তিনি যেসব মতামতধর্মী প্রবন্ধ লিখতেন, তাতেও ছিল গবেষণা ও চিন্তার গভীর ছাপ। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত তাঁর সর্বশেষ বই নবাব সলিমুল্লাহ ও তাঁর সময়। এ ছাড়া প্রথমা থেকে প্রকাশিত তাঁর অন্য বইয়ের মধ্যে আছে অরণ্য বেতার, স্মৃতিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, স্যার ফিলিপ হার্টগ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য, ঢাকার বুদ্ধদেব বসু, কাগমারী সম্মেলন, রবীন্দ্রনাথের ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন এবং নির্বাচিত সহজিয়া কড়চা। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত তাঁর অন্যান্য বইয়ের মধ্যে আছে গোবিন্দচন্দ্র দাসের ঘর-গেরস্থালি, জার্মানির জার্নাল, পারস্যের পত্রাবলি, ভাসানীর ভারতপ্রবাস, মাওলানা আবদুল হামিদ খাঁ, গান্ধী ক্যাম্প, ভাসানী কাহিনি এবং বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রম ও বিশ্বাসহীনতা ইত্যাদি। তাঁর উল্লেখযোগ্য কবিতার বই বিকেলবেলা এবং দারা শিকোহ ও অন্যান্য কবিতা।