ইন্টারনেট এ নানা ধরনের সেবা ব্যবহারের জন্য আছে হরেক রকম সফটওয়্যার, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ব্রাউজার। শুরুতে খুব সাধারণ এইচটিএমএলে তৈরি ছবি ও লেখা দিয়ে তৈরি ওয়েবপেজ দেখানোর দায়িত্বে থাকা ব্রাউজারগুলো আজ ই-মেইল, ভিডিও স্ট্রিমিং, অডিও ও ভিডিও কল থেকে শুরু করে ফটোশপ বা মাইক্রোসফট অফিসের মতো বড়সড় সফটওয়্যারের কাজেরও দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। অথচ প্রতিটি ব্রাউজারের নির্মাতাই সেটি বিনা মূল্যে ব্যবহারকারীদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। ব্রাউজার তৈরি, তার জন্য নিত্যনতুন ফিচার তৈরির গবেষণা ও বাগ ঠিক করার মতো কাজগুলো করতে নির্মাতাদের প্রতিবছর ব্যয় হচ্ছে শতকোটি টাকা। এতে প্রশ্ন আসতেই পারে, যদি ব্রাউজার তাঁরা বিক্রি না করেন তাহলে এই খরচ মিটিয়ে ব্যবসায় লাভ করেন কিভাবে?
ইন্টারনেট কনটেন্ট থেকে যেভাবে আয়
ইন্টারনেটে যত ধরনের কনটেন্ট ও সেবা বিনা মূল্যে পাওয়া যায়, তার পুরো খরচই বহন করে বিজ্ঞাপন। টেলিভিশন বা প্রিন্ট মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার চেয়ে ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন দিলে খরচের তুলনায় বিক্রির পরিমাণ বেড়ে যায় বহুগুণ, তাই সেবা ও পণ্য বিক্রেতারা আজ চেষ্টা করেন সবার আগে ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন দেওয়ার। এর বড় কারণ অ্যাডে সরাসরি ক্লিক করেই ক্রেতা পণ্যটি কিনতে পারছেন। ফলে বিক্রেতাও অ্যাড থেকে সরাসরি কয়টি বিক্রি হয়েছে তা হিসাব রাখতে পারছেন সহজেই। আবার ক্রেতারাও বিজ্ঞাপন দেখেই সরাসরি অর্ডার করতে পারছেন, ফলে বাড়ছে অর্ডারের পরিমাণ।
এখানেই অনলাইন বিজ্ঞাপনের মূল শক্তি নয়। বিজ্ঞাপন গণহারে সবার জন্য সম্প্রচার করা খরচসাধ্য ব্যাপার, তার পরিবর্তে পণ্য বা সেবাটি নেওয়ার মতো ডেমোগ্রাফিক (জনতাত্ত্বিক) অনুযায়ী বিজ্ঞাপন দেখানো হয়, তাহলে কম খরচে বেশি বিক্রি সম্ভব। আর এ কারণেই সব ধরনের কনটেন্টের ওয়েবসাইটই লাভজনক, প্রতিটি সাইটের আছে নিজস্ব একটি অডিয়েন্স, আর প্রত্যেক অডিয়েন্সের জন্যই আছে বিশেষায়িত পণ্য ও সেবা।
সার্চ ইঞ্জিন ও বিজ্ঞাপন
ওয়েবপেজই শুধু নয়, অনলাইন বিজ্ঞাপন থেকে প্রচুর আয় করে থাকে গুগল, বিং ও ইয়াহুর মতো সার্চ ইঞ্জিন। এখানে ব্যবহারকারী সরাসরি তিনি কী খুঁজছেন, সেটাই তুলে ধরছেন সরাসরি, এখানে সেই সার্চের শব্দ অনুযায়ী বিজ্ঞাপন দেওয়া সবচেয়ে কার্যকর। শুধু তা-ই নয়, ব্যবহারকারীর সার্চ ইতিহাস ঘেঁটে তিনি ঠিক কী ধরনের জিনিস পছন্দ করেন, সেই তথ্য চলে যায় সার্চ ইঞ্জিনের হাতে। এই তথ্য অনুযায়ী সাজানো হয় বিজ্ঞাপন, ফলে সার্চ ইঞ্জিনের মূল পাতায় দেওয়া বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠে আরো নিখুঁতভাবে ব্যবহারকারীর সার্চ অনুযায়ী সাজানো। যে সার্চ ইঞ্জিনের যত বেশি ব্যবহারকারী, তার বিজ্ঞাপন থেকে আয় তত বেশি। অতএব মনে রাখতে হবে, সার্চ ইঞ্জিনের নির্মাতা সব সময়ই চাইবেন তাঁদের ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেশি থাকুক।
ব্রাউজার ও সার্চ ইঞ্জিন
বর্তমানে বাজারে থাকা প্রতিটি ব্রাউজারেরই অ্যাড্রেসবারে সরাসরি কি-ওয়ার্ড লিখে করা যায় ওয়েবসার্চ। ফলে ব্যবহারকারীরা আর আলাদা করে গুগল বা বিংয়ের পাতায় গিয়ে তারপর সার্চ করেন না। ব্রাউজারে কোন সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করা হবে অ্যাড্রেসবার শর্টকাটে সেটা নিয়ে চলে বড় দরদাম, কেননা এখান থেকেই সার্চ ইঞ্জিনগুলোর সবচেয়ে বেশি গ্রাহকের ট্রাফিক আসে। ব্রাউজারের নির্মাতাকে তাঁদের সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহারের জন্য মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে থাকেন সার্চ ইঞ্জিন নির্মাতারা, যেটা তাঁদের আয়ের বড় উৎস।
এখানেই শেষ নয়, ব্রাউজার থেকে সরাসরি করা সার্চ থেকে যে আয় করে থাকে সার্চ ইঞ্জিনগুলো, সেগুলোরও একটি অংশ ব্রাউজার নির্মাতা পেয়ে থাকেন। এটাও তাঁদের আয়ের আরেকটি বড় উৎস। ফলে ব্রাউজার নির্মাতা যত বেশি পরিমাণ বাজার ধরতে পারবেন, তত বেশি সেটি সার্চ ইঞ্জিন থেকে করতে পারবেন আয়—হোক সেটা এককালীন সার্চ ইঞ্জিনের সঙ্গে করা চুক্তি থেকে বা সার্চ ট্রাফিকের থেকে পাওয়া ভাগ। বাজার ধরার উপায় একটিই, ব্যবহারকারীকে আরো শক্তিশালী এবং সহজবোধ্য ও নান্দনিক একটি ব্রাউজার উপহার দেওয়া।
অন্যান্য উপায়
যেহেতু গুগল বিশ্বের সবচেয়ে বড় সার্চ ইঞ্জিন, অতএব তারা চাইবেই তাদের বিজ্ঞাপন থেকে আয় হোক সবচেয়ে বেশি। এর ফলেই তারা বিজ্ঞাপন দেওয়ার সেবা অ্যাডসেন্স এবং ব্রাউজার ক্রোম তৈরি করেছে। ফলে ব্যবহারকারীদের পছন্দ তালিকার সব তথ্য তারা জোগাড় করতে পারছে ব্রাউজার ও সার্চ ইঞ্জিন দুটি থেকেই, যার ফলে তাদের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিলে সবচেয়ে বেশি কার্যকর ফলাফল পাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এদিকে গুগলের নিজস্ব ব্রাউজারে গুগল সার্চ ব্যবহারের ফলে তাদের আয়ের কোনো অংশ যাচ্ছে না প্রতিষ্ঠানের বাইরে। এই দুটি উপায় আয় বাড়ানো এবং আয় ভাগ হতে না দেওয়ার কাজটি করে থাকে গুগল, যার মূলে আছে ক্রোমকে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্রাউজার করে রাখা। সঙ্গে আছে বাড়তি পাওনা, ক্রোম অ্যাপ স্টোর থেকেও বিশাল অঙ্কের আয়। ক্রোম ব্রাউজার এভাবেই তিন মাত্রায় আয় করে থাকে।
মজিলা ফায়ারফক্স বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেই কিছুটা আয় করে থাকে, তবে তারা যেহেতু ব্যবহারকারীদের তথ্য বিক্রি করে না, ফলে বাকি আয়ের জন্য তারা গ্রহণ করে ডোনেশন। প্রতিবছর তারা প্রায় ৪৫ কোটি মার্কিন ডলার ডোনেশন পেয়ে থাকে, সেটাই তাদের মূল আয়।
অপেরা ব্রাউজারের আয়ে পুরোটাই বিজ্ঞাপন ঘিরে। নানা ধরনের সেবা প্রদান করার জন্য সংস্থাগুলো অপেরাকে দিয়ে থাকে এককালীন কিছু টাকা এবং বাড়তি রয়ালটি।
এবার আশা যাক মাইক্রোসফট এজ এবং অ্যাপল সাফারিতে। দুটি ব্রাউজারই উইন্ডোজ এবং ম্যাকওএসের সঙ্গে দেওয়া থাকে, আলাদা করে ডাউনলোড করতে হয় না। ফলে অনেক ব্যবহারকারীই কষ্ট করে আরেকটি ব্রাউজার ডাউনলোড না করে সেগুলো ব্যবহার করতে থাকেন। এই কারণে এ দুটি ব্রাউজারও বেশ বড়সড় বাজার ধরে থাকে, আর সেগুলোতে সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার জন্য ইঞ্জিনগুলোর নির্মাতারা মাইক্রোসফট এবং অ্যাপলকে দিয়ে থাকেন বড় অঙ্কের টাকা। সঙ্গে বিজ্ঞাপনের রয়ালটি তো আছেই। মাইক্রোসফটের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরেকটু গভীর, তাদেরও আছে নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিন এবং এক্সটেনশনস স্টোর, যেখান থেকেও তারা পেয়ে থাকে বাড়তি আয়। তবে প্রতিটি অপারেটিং সিস্টেমের নিজস্ব কাজের জন্যই প্রয়োজন হয় একটি ব্রাউজার, ফলে মূলত ব্যাবসায়িক প্রয়োজনে নয়, দুটি কম্পানি ব্রাউজারগুলো বানিয়ে থাকে নিজস্ব প্রয়োজনেই। সার্চ ইঞ্জিন থেকে পাওয়া টাকা বলা যায় বাড়তি আয়।
ব্যবহারকারীর স্বার্থ
স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত মতামত ও পছন্দের তথ্যই আসলে সবার আয়ের উৎস। ব্যক্তিগত তথ্য এভাবে ব্যাবসায়িক কাজে লাগানো হচ্ছে, সে ব্যাপারে অনেকেই অবগত নন। ফলে রাইট টু প্রাইভেসির মতো আন্দোলন দিন দিন হচ্ছে শক্তিশালী। এমনও হতে পারে, ভবিষ্যতে ব্রাউজার আর থাকবে না ফ্রি—তাদেরও বিজ্ঞাপন বাদ দিয়ে আয় করতে হবে সরাসরি ব্যবহারকারীদের থেকেই।
বিএসডি/জেজে