ডেস্ক রিপোর্ট
রাত প্রায় নয়টা। আঁধারে ছেয়ে গেছে পুরো জাহাঙ্গীরনগর। নিস্তব্ধ ক্যাম্পাসের ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণাগারের দিকে আসতে দেখা গেলো একটি সাদা মাইক্রোবাস। দূর থেকে রাস্তার উপর হেডলাইটের লাল আলো পড়েছে। তখনই অদ্ভূত সুন্দর এক ঘটনার অবতারণা। মাইক্রোবাসের আলো দেখে রাস্তার দুপাশ থেকে বেরিয়ে আসলো কয়েকটি প্রাণি। গাড়িটি কাছে আসতেই ঘিরে ধরলো শেয়াল আর কুকুরগুলো।
একটু পরেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলেন একজন ভদ্রলোক। গাড়ি থেকে নামার পর ভেতর থেকে কিছু একটা বের করলেন। তবে এটি দেখে শেয়াল আর কুকুরগুলোর উৎসুক চাহনি নেই, তবে উদগ্রীবতা বেড়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের ওই অধ্যাপক গাড়ি থেকে খাবার বের করলেন। পরের ঘটনা স্পষ্ট আর মানবিকতায় ভরা। খাবারগুলো ওই প্রাণিগুলোর।
এভাবে ক্যাম্পাসের প্রাণিদের প্রতিরাতেই আহার করান অধ্যাপক আলী আজম তালুকদার। তাই তো খাবারের প্যাকেট দেখেও প্রাণিদের উৎসুক চাহনী নেই। এটি নিত্যদিনের। তবে তারা যে অপেক্ষায় থাকেন এই খাবারের তা গাড়ির আলো রাস্তায় পড়ার সময়ই বোঝা গেছে। বন্ধ ক্যাম্পাসে উচ্ছিষ্ট খাবার জোটানোর উপায় নেই ক্ষুধার্ত প্রাণিগুলোর।
তবে ওই অধ্যাপকের এমন মানবিক কাজে তাদের কষ্ট ফুরিয়েছে। করোনায় প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) রাত হলেই প্রাণীদের জন্য খাবার নিয়ে ছোটেন অধ্যাপক আলী আজম তালুকদার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মুরাদ চত্বর, পরিবহন চত্বর ও ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র সংলগ্ন সড়কসহ বিভিন্ন জায়গায় এমন দৃশ্য দেখা যায়।
জানা যায়, করোনায় ক্যাম্পাসের শিক্ষা ও প্রশাসনিকসহ সব কার্যক্রম বন্ধ হওয়ায় এবং শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে না থাকায় হলের ডাইনিং ও ক্যান্টিনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ সব খাবারের দোকান বন্ধ হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে খাবার সংকটে পড়ে ক্যাম্পাসে বসবাসরত প্রাণীরা। এ সময় ক্যাম্পাসের ক্ষুধার্ত প্রাণিগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সালাম-বরকত হলের প্রাধ্যক্ষ ও মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আলী আজম তালুকদার।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২০ সালের ২০ মার্চ থেকে প্রায় দেড় বছর ধরে ক্যাম্পাসের কুকুর, বিড়াল ও শিয়ালকে নিয়মিত খাবার দিচ্ছেন ড. আলী আজম তালুকদার। ক্যাম্পাসের ২৭টি কুকুর ও ১১টি বিড়ালকে প্রতিদিন রাতে খাবার সরবরাহ করছেন তিনি। পাশাপাশি ক্যাম্পাসের ১৫ থেকে ১৬টি শিয়ালগুলোকেও নিয়মিত খাবার দেয়া হচ্ছে। তবে মাঝেমধ্যেই কুকুর, বিড়াল ও শিয়ালের সংখ্যাটা কম বেশি হয়। তাদের প্রতিদিন প্রায় ৫ কেজি চালের গরম ভাতসহ মুরগির গিলা, কলিজা, মাথা ও পা দিয়ে রান্না করা দুই কেজির মতো তরকারি খাওয়ানো হয়। তার এই কাজে প্রতি মাসে শুধুমাত্র খাদ্য ক্রয় বাবদ ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে।
এ উদ্যোগের বিষয়ে অধ্যাপক ড. আলী আজম তালুকদার বলেন, একসঙ্গে ১০-১৫ কেজি মাংসের তরকারি রান্না করে ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা করা হয়। প্রতিদিন ভাত তৈরি হওয়ার আগ মুহূর্তে ফ্রিজ থেকে এক কেজি মাংসের তরকারি বের করে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এনে ভাতের পাতিলের ভেতর সংমিশ্রণ করা হয়। এভাবে রান্না শেষে খাবার ঠান্ডা করে এ সব প্রাণিকে সরবরাহ করা হয়। অসহায় ও অভুক্ত এসব প্রাণির প্রতি মমতা ও ভালোবাসা থেকেই কাজটি করছি।
তিনি আরো বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ণাঙ্গভাবে চালু না হওয়া পর্যন্ত খাদ্য সরবরাহ কাজটি চালিয়ে যাব। যে কর্মচারী-কর্মকর্তারা এই কাজে সাহায্য করছেন তাদের মধ্যে শহীদ সালাম-বরকত হলের রাঁধুনি ও গার্ড, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের পিওন, পরিবহন অফিসের দুইজন গাড়িচালকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এ কাজে সার্বিক উৎসাহ দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম। এছাড়া সম্প্রতি কয়েকজন আর্থিক সহায়তা দিতে চাইলেও গ্রহণ করিনি।
বিএসডি/এমএম