রকমারি ডেস্ক,
দৃশ্যমান ছবির নোটিশবোর্ড বা নোটিশের ভাষা খুবই সহজ হলেও যারা নোটিশটা টাঙিয়েছে তাদের দেশের আইন বড় কঠিন। লোকে তা মানেও। নোটিশটা শান্তির দেশ নরওয়ের সীমান্ত অঞ্চলে টাঙানো হয়েছে নিজ দেশীয় জনগণের উদ্দেশ্যে।
উত্তর ইউরোপের স্ক্যান্ডিনেভিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত নরওয়ে বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ (জনপ্রতি বাৎসরিক আয় ৬২৬,২০০ নরয়েজিয়ান ক্রোনার)। রাজতান্ত্রিক দেশটির বিশাল আয়তন (৩ লাখ ৮৫ হাজার ২৫২ কি.মি.) কিন্তু লোকসংখ্যা হাতেগোনা (৫৪ লাখ, প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বাস ১৬.৫৩ জন)। প্রতিবেশী রাশিয়ার পূর্বাংশের সঙ্গে দেশটির রয়েছে ১৯৬ কি.মি সীমান্ত।
সম্প্রতি দেশটির সংবাদমাধ্যম ব্যারেন্টস অবজারভার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে, নরওয়ের জাকোবসিলভা নদীর তীর এলাকায় একটি সাইনবোর্ড ঝোলানো হয়েছে। সেখানে ইংরেজিতে লেখা হয়েছে ‘রাশিয়ার দিকে মুখ করে মূত্রত্যাগ করা যাবে না। ’
তবে শুধু নিষেধাজ্ঞাই নয়। নির্দেশনা ভঙ্গকারীকে তিন হাজার ক্রোনার জরিমানা গুনতে হবে বলে জানিয়েছে দেশটির সীমান্ত কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় সাড়ে ২৯ হাজার টাকা। জায়গাটি সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় এনেছে তারা।
নরওয়ে বর্ডার গার্ডসের কমিশনার জেন্স হইলান্ড বলেন, ইচ্ছাকৃতভাবে এ ধরনের অপরাধমূলক কাজ বন্ধ করতে সাইনবোর্ডটি ঝোলানো হয়েছে। মূত্রত্যাগ একটি প্রাকৃতিক বিষয়। কিন্তু কোথায় করছেন, তা দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। ওই এলাকায় বিষয়টি সীমান্ত আইন ভঙ্গের আওতায় অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সীমান্তবর্তী নদী জাকোবসিলভার ওপারেই রাশিয়া। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে ওই এলাকায় পর্যটকরা ভিড় করেন। সম্প্রতি সেখানে মূত্রত্যাগের বিষয়ে নরওয়ের কাছে অভিযোগ জানায় রাশিয়া। ছবিটা দেখতে দেখতে মনে পড়লো ফার্মগেটের চিরচেনা দৃশ্যগুলোর কথা। হলিক্রস কলেজ কর্তৃপক্ষ কত বিনয়ের সাথে শত অনুরোধ করে কত কথা বলে সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছে। একসময় তো প্রাচীরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়াই দুষ্কর ছিলো। অশিক্ষিত লোকের না হয় মাথায় ঢোকেনি যে এটা একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শার্ট-প্যান্টের ভদ্দরনোকদের শিক্ষাও তাদের বাঁধা দেয়নি কাজটি করতে। তারাও মূর্খের মতই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ত দেয়াল ঘেঁষে। তেজগাঁও গির্জার পাশের কবরস্থানের দেয়ালে এখনও সে দৃশ্য চোখে পড়ে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পিছন দিকে নাখাল পাড়ায় ন্যাম ভবনে থাকেন দেশের আইন প্রণেতারা। সেই ন্যাম ভবনের দেয়ালের একটা অংশ ব্যবহারই হয় রিক্সাওয়ালা ও পথচারীদের মূত্রত্যাগের কাজে। স্থানীয় লোকেরা ওই জায়গার নাম দিয়েছে মূতের গলি। নিরীহ দেয়ালটা যতটুকু পারে শুষে নেয়, বাকিটা গড়িয়ে আসে পথে, পথচারীদের পা ভেজাতে।
গুগলের কাছে হাত পাততেই এবার গুগল মেলে দিলো ছবির সমাহার। কোনটা কলারোয়ায় শহিদ মিনারের চারপাশে দাঁড়িয়ে মূত্রোৎসব, কোনটা চাঁদপুরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, কোনটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলের পাশের ফুটপাতে প্রস্রাব ঠেকাতে সেখানে ফুল ছিটিয়ে রাখার। রাস্তার পাশে মূত্রত্যাগের কত রকম ছবি যে গুগলের কাছে আছে!
তার কোনটিতে দেখা যাচ্ছে দেয়ালে লেখা আছে, এখানে প্রস্রাব করবেন না, দয়া করে এখানে প্রস্রাব করবেন না। কোথাও বা কাগজে লিখে টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়েছে ৫০ থেকে ৫০০ টাকা জরিমানার নোটিশ।
উপায় না পেয়ে ধর্ম মন্ত্রনালয় এক কৌশলী উদ্যোগ নিয়েছে। রাজধানীর অনেক রাস্তার দেয়ালে আরবিতে উপরে ‘এখানে প্রস্রাব করা নিষেধ’ এবং নিচে বাংলায় ‘সামনে মসজিদ, … গজ দূরে পাবলিক টয়লেট’ লিখে দিয়েছে। কতটুকু কাজ হয়েছে জানি না। কারণ এখনও যত্রতত্রই মূত্রকাণ্ড দেখতে পাই, অনেক রাস্তার পাশ দিয়ে হাটতে গিয়ে নাক চেপে ধরতে হয়। উড়ালসেতুতে পর্যন্ত জলবিয়োগের এ দৃশ্য চোখে পড়ে। আমাদের কি তাহলে পাবলিক টয়লেটের এতই অভাব, জনসংখ্যাবহুল দেশে ভ্রাম্যমান পাবলিক টয়লেট স্থাপন কত জরুরি তা এসব দৃশ্য দেখলে বুঝা যায়।
নরওয়ে বর্ডার গার্ডসের কমিশনার জেন্স হইলান্ড-এর বলা কথা বারবার খোঁচা দিচ্ছে মনে, ‘মূত্রত্যাগ একটি প্রাকৃতিক বিষয়। কিন্তু কোথায় করছেন, তা দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার।’ মানছি জেন্স হইলান্ড আধুনিক, সুশিক্ষিত ও সভ্য দেশের মানুষ বলে নিজ দেশ, দেশের সীমানা পেরিয়ে প্রতিবেশী দেশের সম্মানের কথা ভাবতে পেরেছেন। শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য আইন করতে পেরেছেন। আমরা কি নিজের দেশের কথাও ভাবতে পারি না? আমাদের বোধের জগত কি এত সংকীর্ণ যে, আমরা একটা শিক্ষা কিংবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মর্যাদাও বুঝবো না?
বিএসডি/এএ