নিজস্ব প্রতিবেদক
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে শুরু করে ৫ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত রাজধানীতে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে প্রত্যেকটি হত্যার বিচার দাবি করেছেন শাহাদাতবরণকারী শহীদ পরিবারের সদস্যরা।
তারা বলছেন, প্রত্যেকটি হত্যার বিচার হতে হবে। যদি সুষ্ঠু বিচার করা না হয় তাহলে যতই সরকার পরিবর্তন হোক, যতই সংস্কার হোক, লাভ হবে না, শান্তিশৃঙ্খলা ফিরবে না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অধীনে প্রত্যেকটি গুম-খুন ও হত্যার বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
রোববার (২৭ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে শহীদ পরিবারের গর্বিত সদস্যদের নিয়ে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগর উত্তর। সেখানে কূটনৈতিক, বিভিন্ন জাতীয় রাজনৈতিক নেতারা, আলেম-ওলামা, বিভিন্ন শ্রেণিপেশার প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে বিচারের দাবি জানান শহীদ পরিবারের সদস্যরা।
কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত শহীদ আসাদুল ইসলামের স্ত্রী কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, গত জুলাই মাসের ১৮ তারিখ আমার স্বামী মারা গেছে। তখন আমি গর্ভবতী ছিলাম। আমার স্বামী তো নিরপরাধ ছিল। অথচ আমার গর্ভের সন্তান বাবার মুখটাও দেখতে পারল না। একটা না, তিন তিনটা গুলি লাগছিল ওর গায়ে। আমি বিচার চাই। আমার সন্তান পৃথিবীতে বাবা ডাক ডাকতে পারল না, এই কষ্ট কাকে বোঝাবো?
এসময় কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তার কান্নায় নীরবতা ভেঙে হলরুমে বিচারের দাবিতে চিৎকারে ফেটে পড়েন সভায় অংশ নেওয়া জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা। কান্নায় কণ্ঠ আড়ষ্ট হয়ে আসায় বক্তব্য আর বাড়াতে পারেননি শহীদ আসাদুল ইসলামের স্ত্রী।
রাজধানীতে শহীদ খালিদ হাসান সাইফুল্লাহর বাবা কামরুল হাসান বলেন, প্রত্যেকটা পরিবারের বড় ছেলে তাদের জীবনের স্বপ্ন ও স্মৃতিকে ধারণ করে। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হয় তাকে ঘিরেই। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দুর্বৃত্ত পুলিশের গুলিতে আজিমপুর স্টাফ কোয়ার্টারের ভেতরে নির্মমভাবে নিহত হয় আমার ছেলে। আন্দোলনের ভেতরে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে সে গুলিবিদ্ধ হয়। অথচ ওই এলাকা ছিল সংরক্ষিত এলাকা। সে শান্তিপূর্ণ মিছিলে গত ১৮ জুলাই অংশ নিয়েছিল। শুরু থেকেই আন্দোলনে ছিল।
তিনি বলেন, সেদিন বাসায় ও বলে গিয়েছিল আছরের নামাজ পড়তে যাচ্ছে। দুপুরের পরও সে বাসায় ছিল। দুপুরের খাবারের আগে আগে সে বাসায় আসে। আছরের নামাজের আগে সে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর সে রাইফেলের গুলিতে বিদ্ধ হয়। তার সঙ্গী-সাথীরাও গুলিতে আহত হয়ে ছোটাছুটি করছিল। খুব কাছ থেকে তিনজন পুলিশ দাঁড়িয়ে গুলি করে।
কামরুল হাসান বলেন, কতটা নির্মম, নির্দয়, পাষাণের মতো খালিদ সাইফুল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে। লালবাগ থানায় যখন তার মরদেহ নিতে যাচ্ছিলাম। একজন পুলিশ সদস্য বলছিলেন, টুপি দাড়িওয়ালাদের হত্যা করলে নাকি নেকি হয়। টুপি দাড়িওয়ালারা নাকি শত্রু। তাদের ভাষাই বদলে গিয়েছিল। ৫ আগস্টের পরে চিত্র বদলে গেছে। যারা শহীদ হয়েছেন প্রত্যেকের হত্যার বিচার এই বাংলার মাটিতে হতে হবে। আমি শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে বলতে চাই, বাংলার মসনদে আর কোনো স্বৈরাচারকে বসতে দিতে পারি না।
সূত্রাপুরের শহীদ ওমর ফারুকের গর্বিত মা কুলসুম আক্তার বলেন, আমার ছেলের বুকে তিনটা গুলি করা হয়েছে। সরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি। আমার ছেলের বুকে যারা গুলি করেছে আমি তাদের বিচার চাই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে বিচার চাই। শুধু আমার ওমর ফারুক হত্যার বিচার নয়, সব শহীদের হত্যার বিচার করতে হবে।
তিনি বলেন, আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছে, সংসারটা তছনছ হয়ে গেছে। পুরো পরিবার ভেঙে পড়েছে। যেসব ছাত্রলীগ ও পুলিশ সদস্য গণহত্যায় জড়িত তাদের প্রত্যেকের বিচার করতে হবে। কার কার হাত ছিল তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আমার ক্ষতি কেউ পোষাতে পারবে না কিন্তু বিচার তো চাই, বিচার হতেই হবে।
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরে হাফেজ গোলাম কিবরিয়ার বাবা তাজুল ইসলাম বলেন, ২৮ অক্টোবর খুনি হাসিনার লগি-বৈঠার তাণ্ডব আইয়ামে জাহেলিয়াতকেও হার মানায়। টার্গেট করেই লগি-বৈঠা নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ঢাকায় আসতে বলেছিল শেখ হাসিনা। কোমলমতি ছেলেগুলোকে কীভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে বিশ্ব দেখেছে। এর বিচার আমরা পাইনি। বাংলাদেশে কোরআনের শাসন কায়েমের মাধ্যমে এর প্রতিদান দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
২৮ অক্টোবরের আরেক শহীদ সাইফুল্লাহ মাসুমের বাবা মাহতাব উদ্দিন বলেন, খুনের ওপর দিয়েই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল। খুনের মধ্য দিয়েই বিদায় নিয়েছে। প্রত্যেকটি হত্যার বিচার হতে হবে। যদি সুষ্ঠু বিচার করতে না পারেন তাহলে যতোই সরকার পরিবর্তন হোক, যতই সংস্কার করেন কোনো লাভ হবে না, শান্তিশৃঙ্খলা ফিরবে না। যদি বিচার হতো তাহলে খুনের পর খুন করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে পারত না।
লক্ষ্মীপুর জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির শহীদ ডা. ফয়েজ আহমেদের ছেলে হাসানুল বান্না বলেন, আজ শহীদী পরিবারের সদস্য হিসেবে এখানে উপস্থিত হতে পারব ভাবিনি। নিরপরাধ বাবাকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তা বিরল।
তিনি বলেন, ২০১৩ সালের বুদ্ধিজীবী দিবসের রাতে ১৪ ডিসেম্বর খুনি হাসিনার বাহিনী যৌথ অভিযান পরিচালনা করে। বাসার ছাদে নিয়ে হাত-পা বেঁধে নির্মমভাবে হত্যা করে ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও সেদিন রাতে রিভলভারের বাট দিয়ে থেঁতলে দিয়েছিল মাথা। মা উপর থেকে চিৎকার করে বলেছিল তোমরা কি অমানুষ।
হাসানুল বান্না বলেন, শুধু নিজের ক্ষমতার লোভ চরিতার্থ ও ক্ষমতা দীর্ঘায়ত করার জন্য বাহিনীগুলোকে খুনি বাহিনীতে পরিণত করেছিলেন। আমি শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে দাবি জানাই, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রত্যেকটির হত্যার বিচার যেন নিশ্চিত করা হয়। যাতে করে ভবিষ্যতে কোনো দল বা সরকার ফ্যাসিস্ট রূপ ধারণ করতে না পারে।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তিনি দাবি জানিয়ে বলেন, প্রত্যেকটি হত্যার নেপথ্যের কারিগর পলাতক শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনুন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আওতায় বিচারের মুখোমুখি করুন।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিনের সভাপতিত্বে ও কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য এবং ঢাকা মহানগর উত্তরের সেক্রেটারি ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিমের পরিচালনায় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন সংগঠনের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দীন আহমেদ, জামায়াত সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমির নূরুল ইসলাম বুলবুল, ১২ দলীয় জোট প্রধান, সাবেক মন্ত্রী মোস্তফা জামাল হায়দার, এলডিপির মহাসচিব ও সাবেক মন্ত্রী ড. রেদোয়ান আহমদ, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আব্দুল কাদের, এনপিপি চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও ঢাবি ছাত্র শিবিরের সেক্রেটারি এস এম ফরহাদ, বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, গণঅধিকার পরিষদের সদস্য সচিব ফারুক হাসান, জাতীয় গণতান্ত্রিক দল জাগপার মুখপাত্র রাশেদ প্রধান, গণঅধিকার পরিষদের(নুর) সদস্য সচিব রাশেদ খান, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন।