নিজস্ব প্রতিবেদক,
শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে কালীগঞ্জ পৌর এলাকার মূলগাঁও (জেলেপাড়া)। এই জেলে পল্লিতে ৩০টি পরিবারের বসবাস। একটি পরিবারের প্রধান সাধু (৬৫)। শীতলক্ষ্যা নদীকে ঘিরেই তার জীবনজীবিকা। তিন ছেলে তিন মেয়ের বাবা সাধু কার্যত বেকার। কখনো রিকশাভ্যান চালিয়ে কখনো বা দিনমজুরের কাজ করে সংসারের খরচ মেটাচ্ছেন তিনি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তার চোখে-মুখে শুধুই আক্ষেপ।
সাধু বংশগত নিয়মেই শীতলক্ষ্যায় মাছ ধরার পেশাকে বেছে নেন। তবে এখন আর শীতলক্ষ্যায় মাছ নেই। তাই পেশা বদল করার পথ খুঁজছেন। তবে বয়স হয়েছে বলেও অন্য কোন পেশায়ও সহজে যেতে পারছেন না। শুধু সাধু নয়, একই অবস্থা পার্শ্ববর্তী পলাশ উপজেলার ডাঙ্গা ইউনিয়নের ইসলাম পাড়া গ্রামের কুদরত উল্লাহ (৪০), একই উপজেলার চরসিন্দুর এলাকার ষাটোর্ধ সুজন চন্দ্র দাসেরও।
সাধু আরো জানান, শীতলক্ষ্যার পানি এখন এমনভাবে পচে গিয়েছে যে নদীর ৭/৮ হাত গভীরে মাটির নীচে শামুক পর্যন্ত মরে গিয়েছে। মাছ পাওয়া তো দূরের কথা। শীতলক্ষ্যা এখন গোসল করারও উপযোগী নেই। আগে আমাদের বউ-বেটিরা শীতলক্ষ্যা থেকে জল নিয়ে যেত। সেই জল দিয়ে রান্না-বান্না চলতো। আমরা শীতলক্ষ্যার জল খেতাম। কিন্তু এখন সেটা পারি না।
তিনি বলেন, এক সময় শীতলক্ষ্যার জল এতই পরিষ্কার ছিল যে সেই জল খেয়ে বহু মানুষের অসুখ-বিসুখ সারতো। এখন শীতলক্ষ্যার জল খেলে মানুষের অসুখ করবে।
১২ মাস মাছ ধরে সংসার চালানো কুদরত উল্ল্যাহ বলেন, এখন মাছ ধরতে হলে আমাদের ভাটিতে যেতে হয় চাঁদপুরের কাছাকাছি। কিন্তু সেই নদীতে মাছ ধরার জন্য যত বড় জাল লাগে সেই জাল আমাদের নেই। একটা জাল তৈরি করতে লাখ লাখ টাকা লাগে। এত টাকা আমরা কোথায় পাব? একটা নৌকাতে ৪/৫ জন আমরা জেলে কাজ করি। এই ক`জন মানুষের খরচ, তারপর তেলের খরচ দিয়ে অত দূরে গিয়ে মাছ ধরা পোষায় না। তাই অনেক কষ্টে আমাদের দিন চলছে।
সুজন চন্দ্র দাস বলেন, শীতলক্ষ্যায় আমরা এক সময় সব ধরনের মাছ দেখেছি। আমার বয়স এখন ৬২ বছর। ৭/৮ বছর বয়সে আমার জ্ঞান হওয়ার পরে থেকেই আমি আমার বাপ-দাদাকে দেখেছি তারা প্রচুর মাছ ধরতেন। বড় মাছ থেকে ইঁচা মাছ সব ধরনের মাছই তারা ধরতেন। নদীর গভীরে বড় বড় পাঙ্গাশ পাওয়া যেত। ইলিশ মাছও ছিল শীতলক্ষ্যায়। এমন কোন মাছ ছিল না যেটা শীতলক্ষ্যায় পাওয়া যেত না। কিন্তু এখন সেই দিন নেই।
বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল কালীগঞ্জ উপজেলা শাখার সভাপতি সাংবাদিক আব্দুর রহমান আরমান জানান, গত কয়েক বছরে শীতলক্ষ্যা তীরের বিভিন্ন জায়গায় উচ্ছেদ চালিয়ে অবৈধ দখলমুক্ত করা হলেও দূষণের মাত্রা কমেনি। একটা সময় শিল্প স্থাপন করাটাই গুরুত্ব পেয়েছিল বেশি, পরিবেশ নয়। এখন সময় এসেছে নদী খাল-বিল ও জলাশয় রক্ষা করতে হবে। বিশেষ করে শীতলক্ষ্যা পাড়ে যেসব শিল্পকারখানা আছে তাদের অনেকেরই তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার বা ইটিপি নেই। যাদের ইটিপি আছে খরচ বাঁচানোর জন্য তাদের অনেকেই সেটি ব্যবহার করছে না। ফলে বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ছে।
কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শিবলী সাদিক জানান, কারখানাগুলো যাতে বর্জ্য পরিশোধন করে সেটি তারা তদারকি করছেন। এখন ইটিপি ছাড়া কোনো কারখানাকে অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না। তবে নদী দূষণে শুধু কারখানার বর্জ্য একা দায়ী নয়। পাশাপাশি পয়ঃবর্জ্য ও গৃহস্থালী বর্জ্যও নদীতে ফেলা হচ্ছে। দূষণের দায়ে বিভিন্ন সময় মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করা হচ্ছে।
দূষণ রোধে সব রকম চেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলেও জানান উপজেলার প্রশাসনের এই কর্মকর্তা।
বিএসডি/আইপি