ডা. মেখলা সরকার
হঠাৎ করেই এমন ঘটনা ঘটে, যা ওলট-পালট করে দেয় সবকিছু। মেনে নিতে হয় জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত কোনো পরিবর্তন। দীর্ঘদিন ধরে একটু একটু করে গুছিয়ে নেওয়া জীবন যেন মুহূর্তের মধ্যে হয়ে পড়ে অগোছালো, পরিচিত জগৎ হয়ে যায় অপরিচিত। হঠাৎ করেই চলে আসে খারাপ সময়।
কী ভাবে সামলাবেন?
* কোনো ঘটনার কারণে আপনার জীবনের যে আকস্মিক পরিবর্তন, সেটা যতই অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্ক্ষিত হোক না কেন, সেটা গ্রহণ করুন। মেনে নিন। যত দ্রুত গ্রহণ করতে পারবেন, তত দ্রুত আপনি পরিবর্তিত জীবনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারবেন।
* জীবনের নতুন অবস্থা যেমনই হোক, তা ভালোবাসুন।
* খুব নেতিবাচক পরিস্থিতির মধ্যেও ছোটখাটো নানা ভালো কিছু আশপাশে ছড়িয়ে থাকে, যা আপাতভাবে আমরা ততটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না। আপনার আর্থিক সচ্ছলতা, পরিবারের সহযোগিতা, নিজের সুস্বাস্থ্য—ইতিবাচক এসব দিকের প্রতি আলাদা মনোযোগ আপনাকে একরকম শক্তি জোগাবে, যা এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে সাহায্য করবে।
* পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন, সামাজিক অনুষ্ঠানে যান, প্রয়োজনে আপনার কষ্টের কথা আপনজনকে প্রকাশ করে নিজেকে হালকা করুন। কাছের মানুষের ভালোবাসা আপনাকে আস্থা ও বিশ্বাস জোগাবে। মানুষের সঙ্গে সংযোগ আপনাকে নতুন পথ এবং সম্ভাবনার নতুন আলো দেখাতে সাহায্য করবে।
* কষ্ট হলেও নিজের যত্ন নিন। একটু একটু করে নিজেকে পরিপাটি রাখা, নিজের কিছু কিছু শখ পূরণ করা, আয়নায় নিজেকে দেখা ইত্যাদি আবার আপনাকে ভালোবাসতে সাহায্য করবে। মিউজিক শুনুন, ব্লগ লিখুন, ছবি আঁকুন, বাগান করুন।
* প্রতিদিন অন্তত ৪০ মিনিট দ্রুত হাঁটুন বা ব্যায়াম করুন। এই অভ্যাস আপনার মন ও শরীরের স্থবিরতা ও অবসাদ কাটাতে সাহায্য করবে।
* নিজেকে বারবার আশ্বস্ত করুন যে জীবনের এই খারাপ সময়টা শুধু একটা সাময়িক অবস্থা এবং কখনোই ‘শেষ পরিণতি’ না। জীবনের কোনো কিছুই যেমন স্থায়ী না, তেমনি এই খারাপ সময়টাও অবশ্যম্ভাবীভাবে একসময় শেষ হবে। একটু পেছনে ফিরে তাকালেই দেখবেন ছোটখাটো নানা কঠিন সময় আরও এসেছিল, আপনার জীবনে যা আপনি ঠিকই পার করে ফেলেছেন। সামনে আরও নানা সুন্দর ও সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে।
* ঘুমের সমস্যা, খাওয়ায় অরুচি অনেক দিন ধরে থাকলে বা আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় এলে দেরি না করে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
কোনো ঘটনা, সেটা যতই কঠিন হোক না কেন, সময়ের সঙ্গে সেই অবস্থা সামলে জীবনের স্বাভাবিক গতিপ্রবাহে আমরা সবাই ফিরে আসি। মনে রাখা প্রয়োজন যে জীবনের কিছু পরিবর্তন আপাতভাবে যতখানি অগ্রহণযোগ্য বা চাপদায়ক মনে হয়, সত্যিকার অর্থে ততখানি অগ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারে। বরং বলা যায়, জীবনের এসব পরিবর্তনকে ব্যক্তি অনাকাঙ্ক্ষিত হিসেবে দেখছে বলেই সেগুলো চাপদায়ক বা অগ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, কোনো কিছু কাকে কতটুকু পর্যুদস্ত করবে, তা অনেকখানি নির্ভর করে ঘটনাটা বা জীবনের পরিবর্তনটা কে কীভাবে দেখছে। দেখার দৃষ্টি একটু পরিবর্তন করলেই কিন্তু সহনীয় হয়ে উঠতে পারে আপনার এই দুঃসহ সময়টা।
যা করবেন না
* কষ্ট কমানোর জন্য ধূমপান বা যেকোনো নেশা থেকে বিরত থাকুন।
* ঘুমের সমস্যায় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ঘুমের ওষুধ খাবেন না।
* বিচ্ছেদজাতীয় ঘটনার ক্ষেত্রে ‘সব সময়’ সাবেক ব্যক্তিকে নিয়ে কথা বলা থেকে বিরত থাকুন।
* নিজেকে গুটিয়ে ফেলবেন না। সারা দিন শুয়ে থাকবেন না বা নিজেকে রুটিনহীন করবেন না।
* ভার্চ্যুয়াল জগতে নির্ভরতা বাড়াবেন না।
* নিজেকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করবেন না।
* নিজেকে একা রাখবেন না।
* বর্তমান সমস্যার সম্পূর্ণ দায়ভার অন্যের কাঁধে ফেলা বা অন্যকে দোষারোপ থেকে বিরত থাকুন।
* কষ্ট কমানোর জন্য হুট করে গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত (যেমন বিয়ে করে ফেলা, নতুন সম্পর্কে জড়ানো, চাকরি ছেড়ে দেওয়া ইত্যাদি) নেবেন না।
কী করতে পারেন?
* আপনি ভালোবাসেন বা পছন্দ করেন এমন কোনো কাজ প্রতিদিন অন্তত একটা হলেও করুন।
* চিন্তামূলক কাজে মনঃসংযোগ না করতে পারলে শারীরিক কাজ করুন। নিজেকে অলস হতে দেবেন না।
* কান্না পেলে কাঁদুন।
* শিশু ও প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটান।
* নতুন জায়গায় বেড়াতে যান, নতুন মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে।
* সামাজিক সেবামূলক কাজ করুন।
* স্বেচ্ছাশ্রম হলেও নিজেকে ব্যস্ত রাখুন।
ডা. মেখলা সরকার
সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।