ভারত সীমান্তবর্তী দেশের সাত জেলায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হঠাৎ করেই ব্যাপক হারে বেড়েছে। একইসঙ্গে জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় নানা সংকটের কারণে বাড়তে শুরু করেছে মৃতের সংখ্যাও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সীমান্তবর্তী কোনো জেলাতেই রোগীরা ঠিকমতো আইসিইউ সাপোর্ট পাচ্ছেন না। ফলে সংকটাপন্ন অবস্থায় তাদের বিভাগীয় শহর, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা রাজধানীতে নিয়ে যাওয়ার আগেই রাস্তায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জেলা হাসপাতালগুলোতে তীব্র জনবল সংকট। সব মিলিয়ে চিকিৎসা ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে চরম এক অব্যবস্থাপনা।
সরকারি নীতি অনুযায়ী, প্রতিটি জেলা সদর হাসপাতালে ১০ থেকে ২০ বেডের আইসিইউ থাকা বাধ্যতামূলক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গাইডলাইন অনুযায়ী, ১০০ বেডের হাসপাতালে কমপক্ষে ১০ বেডের আইসিইউ থাকতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, সাতক্ষীরা, যশোর, রাজশাহী ও চুয়াডাঙ্গায় ভারতীয় ধরনে অধিক সংখ্যক মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে। তবে এসব জেলার অধিকাংশ হাসপাতালেই নেই করোনা চিকিত্সার পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ২৫০ বেডের জেলা সদর হাসপাতালে ২০ বেডের কোভিড ইউনিট থাকলেও কোনো আইসিইউ নেই। রোগীর অবস্থা খারাপ হলেই আইসিইউ সাপোর্টের জন্য নিয়ে যেতে হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। একই অবস্থা অন্য জেলা হাসপাতালগুলোতেও।
বাস্তবায়ন হয়নি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা
করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় গতবছরের ২ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিটি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপন, ভেন্টিলেটর স্থাপন এবং উচ্চমাত্রার অক্সিজেন সরবরাহের নির্দেশ দেন। কিন্তু এতদিনেও জেলা পর্যায়ে আইসিইউ ইউনিট তৈরি না হওয়ায় স্বাস্থ্য বিভাগের গাফিলতিকে দায়ী করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও জেলা হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ স্থাপন না করাকে স্বাস্থ্য বিভাগের চরম ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন তারা।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলোজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যেখানে প্রতিটি জেলায় আইসিইউ স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন, সেখানে এতদিন পার হয়ে গেলেও নির্দেশনার বাস্তবায়ন হয়নি। এটা আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগের চরম একটি ব্যর্থতা। আমি জানতে চাই- কেন তারা প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনাটি বাস্তবায়ন করেনি? এখন কি তারা আইসিইউর অভাবে যে মানুষগুলো মরছে তাদের দায় নেবে?’
তিনি বলেন, ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ বর্ডারের কয়েকটি জেলায় আবারও সংক্রমণ বাড়ছে। সরকার ইতোমধ্যেই চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় গত সোমবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য বিশেষ লকডাউন ঘোষণা করেছে। এখন অন্য জেলাগুলোতে দিন দিন শনাক্তের হার যেভাবে বাড়ছে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করা ৩৭ জেলায় আবার লকডাউন ঘোষণা করা যেতে পারে।’
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘ঈদে কয়েক লাখ মানুষ ঢাকা থেকে নিজ নিজ গ্রামে গিয়েছিল। ফলে গ্রামগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মানুষের লোকসমাগম হয়। যা সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার অন্যতম একটি কারণ। আবার সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অসংখ্য মানুষ সংক্রমণ নিয়ে দেশে এসেছে। সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপের কথা বলা হলেও সেটা করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।’
পরিস্থিতি একটু জটিল হলেই লাগছে আইসিইউ
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, ‘করোনা চিকিৎসার অন্যতম উপাদান আইসিইউ। পরিস্থিতি একটু জটিল হলেই রোগীদের আইসিইউ লাগে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে আইসিইউ না থাকায় সংকটাপন্ন রোগীদের নিয়ে যেতে হচ্ছে বিভাগীয় হাসপাতালে বা তাদের অনেককেই আসতে হচ্ছে ঢাকায়। এটি একটি চরম দুর্ভোগ।’
তিনি বলেন, ‘ঈদকে কেন্দ্র করে যেভাবে মানুষ কেনাকাটা ও গ্রামের বাড়িতে যাওয়া শুরু করেছিল, সংক্রমণ তো বাড়বেই। আমরা আগেই বলেছিলাম ঈদের ১০ থেকে ১৪ দিন পরেই এর প্রভাব দেখা যাবে। এখন তা-ই দেখা যাচ্ছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতেও সংক্রমণ বাড়ছে, এক্ষেত্রে করোনার ভারতীয় ধরনও কাজ করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।’
করণীয় প্রসঙ্গে মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এই মুহূর্তে করণীয় একটাই, সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। যেখানে রোগী বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা আছে, সেখানে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে গত মার্চের মতো অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ করেই সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।’
সব জেলায় আইসিইউ স্থাপনের কাজ চলছে : স্বাস্থ্যমন্ত্রী
এসব বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গণমাধ্যমকে বলেন, করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য দেশের সব জেলা সদর হাসপাতালে হাই-ফ্লো-ন্যাজাল ক্যানোলা পাঠানো হয়েছে। এটি থাকলে আর আইসিইউয়ের প্রয়োজন হয় না। তিনি বলেন, জেলা পর্যায়ে আইসিইউ আগে ছিল না। বর্তমানে সব জেলায় আইসিইউ স্থাপনের কাজ চলছে।
এদিকে করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি সম্প্রতি অধিক সংক্রমিত সীমান্তবর্তী সাত জেলায় সর্বাত্মক লকডাউন দেওয়ার সুপারিশ করেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীও এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন।
সীমান্তবর্তী সাত জেলায় বিশেষ লকডাউন চায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়
করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি দেখা দেওয়ায় সীমান্তবর্তী সাত জেলায় বিশেষ লকডাউন বাস্তবায়ন চায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ লক্ষ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাছে একটি সুপারিশ পাঠানো হয়েছে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। গতকাল (সোমবার) রাতে এ নিয়ে বৈঠক করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত আজ নির্দেশনা আকারে মাঠ প্রশাসনে পাঠানো হতে পারে। তবে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় চাঁপাইনবাবগঞ্জে দ্বিতীয় দফায় লকডাউন ঘোষণা করেছে জেলা প্রশাসন। ১ জুন থেকে ৭ জুন পর্যন্ত এ লকডাউন কার্যকর থাকবে। সারা দেশে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধের মধ্যেই ২৪ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসন প্রথম দফায় লকডাউন ঘোষণা করেছিল। তখন থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সঙ্গে সারা দেশের গণপরিবহন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আছে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, আমাদের সীমান্ত এলাকায় মৃত্যু এবং আক্রান্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এজন্য কারিগরি কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী সীমান্তের সাত জেলায় দ্রুতই সর্বাত্মক লকডাউন দেওয়া হবে। এছাড়া যেসব জেলায় করোনার সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী সেখানে লকডাউন দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লকডাউন দিয়ে দেওয়া উচিত, তাহলে সংক্রমণ ছড়ানো রোধ করা যাবে।