আরমান হাসান:
দেশের অন্যতম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতি ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জমা দেওয়ার ৫ বছর অতিবাহিত হলেও শনাক্ত হয়নি প্রশ্ন ফাঁসের মূলহোতারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির ‘এ’ ইউনিটে (বিজ্ঞান ও লাইফ অ্যান্ড আর্থ সায়েন্স অনুষদভুক্ত) এই ফাঁসের ঘটনা ঘটেছিল। অভিযোগ উঠেছে, তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিলেও, সেই প্রতিবেদন সিন্ডিকেট সভায় না তুলে ‘চাপা দেওয়া’ হয়েছে। ফলে থমকে গেছে জালিয়াতির তদন্ত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানান, ২০১৬-১৭ সেশনে এ (বিজ্ঞান) ইউনিটের প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগের পর শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা বাতিল চেয়ে পুনরায় পরীক্ষা নেওয়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তদন্ত কমিটি গঠন করে। সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও দীর্ঘদিন পর জমা দেওয়া হয় সে প্রতিবেদন। প্রতিবেদন পাওয়ার আগেই জবি প্রশাসন ২০১৬-১৭ সেশনের ভর্তি কার্যক্রম শুরু করে দেয় এবং পরবর্তীতে এ বিষয়ে আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
ফলে প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে ভর্তি হওয়া এসব শিক্ষার্থীদের অনেকে বারবার অকৃতকার্য হয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করতে না পারার শঙ্কায় রয়েছেন। তাদের কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও ঘটাচ্ছে।
তৎকালীন তদন্ত কমিটির প্রধান ড. সরকার আলী আক্কাস বলেন, ‘আমি এরকম কোনো কমিটির দায়িত্বে ছিলাম কিনা স্মরণ করতে পারছি না। আমি আলী আক্কাস জগন্নাথে বহু কমিটির দায়িত্ব পালন করছি। এতদিন পর এসে কোন কমিটিতে কি প্রতিবেদনে দিয়েছি তা তো মনে রাখা সম্ভব না। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিসে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।’
বিশ্বদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী ওহিদুজ্জামান বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কোনো তথ্য জানি না। প্রতিবেদন জমা দিলেও দিতে পারে। তবে তা তৎকালীন ভিসি বলতে পারবেন।’
তদন্ত কমিটির আরেক সদস্য ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান জানান, ‘আমাদের ৩ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটির রিপোর্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে জমা দিয়েছিলাম। এতে প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হয়েছে। প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার পর প্রশ্ন পাওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাক্ষাৎকার ও অন্যান্য বেশকিছু প্রমাণ তদন্ত রিপোর্টে যুক্ত করেছিলাম। আমরা প্রশ্ন ফাঁসের সাথে জড়িত কোনো শিক্ষকের নাম উল্লেখ করতে পারিনি।’
‘তবে আমরা বলেছিলাম, তৎকালীন ভর্তি পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা প্রধান সমন্বয়কারী তার দায়ভার এড়াতে পারেন না। কেননা পরীক্ষা শুরু হওয়ার ৩-৪ ঘণ্টা আগে প্রশ্ন ফাঁস হয়। যা দায়িত্বে থাকা প্রধানের কনসার্ন ছাড়া কোনোভাবে সম্ভব না। রিপোর্টে পরীক্ষা বাতিল করে পুনরায় নেয়ার সুপারিশও করা হয়েছিল। আমরা আরও সুপারিশ করেছিলাম আমাদের দেওয়া রিপোর্টের ভিত্তিতে অধিকতর তদন্তের জন্য গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতা নেওয়ার জন্য’, বলেন তদন্ত কমিটির এই সদস্য।
২০১৬-১৭ সেশনের প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া এ (বিজ্ঞান) ইউনিট ভর্তি পরীক্ষার প্রধান সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা লাইফ অ্যান্ড আর্থ সাইন্স অনুষদের তৎকালীন ডিন অধ্যাপক ড. মো. জাকারিয়া মিয়া বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারছি না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে।’
২০১৬-১৭ সেশনে প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. কাজী সাইফুদ্দিন বলেন, ‘তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জমা দেওয়া হলেও, জবির সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বিষয়টি সিন্ডিকেটে তোলেননি। বিষয়টি কেন ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে তিনিই বলতে পারবেন। ভর্তি পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা ডিন সাহেব যদি সজাগ থাকেন, তাহলে তো প্রশ্নফাঁসের সুযোগ নেই। কিভাবে ফাঁস হলো, কারা করলো তিনিই ভালো জানবেন।’
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৬-১৭ সেশনের ‘এ’ ইউনিটের পরীক্ষার দিন প্রশ্নপত্রসহ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করার সময় এক পরীক্ষার্থীকে আটক করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসার পরে বিকেল তিনটার দিকে ক্যাম্পাসের সামনে কনফিডেন্স বিসিএস কোচিং সেন্টারে অভিযান চালিয়ে কোচিং পরিচালকসহ আরও কয়েক জনকে আটক করা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে আটকদের বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড দেওয়া হয়।
দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- বিসিএস কনফিডেন্স কোচিং সেন্টার জবি ক্যাম্পাসের পরিচালক এম রহমান রনি, জবির বাংলা বিভাগের ছাত্রলীগ কর্মী সাইফ আহমেদ লিখন, ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী আব্দুর রহমান ও মোশতাক আহমেদ। ঢাকা জেলার তৎকালীন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রহিমা আক্তার এ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছিলেন।
বিএসডি / আইকে