তিন বছর আগে সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট উভয় বিভাগে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের অধীনে ৩৪ আইনজীবীকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি) পদে নিয়োগ দেয় সরকার। তবে, ওই ডিএজিদের মধ্য থেকে ছয়জনের কার্যক্রম এবং বেতন-ভাতা বন্ধ রয়েছে। এছাড়া তাদের কাজ ও বেতন-ভাতার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে কোনো আদেশ বা নির্দেশনাও জারি হয়নি। সেজন্য ছয় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল রয়েছেন অনেকটা অন্ধকারে। তাদের মধ্যে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাও রয়েছেন।
জানা যায়, ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে তাদের বেতন দেয়া হচ্ছে না। যদিও সরকারের নিয়োগের (অ্যাপয়েন্টমেন্ট) চিঠি তাদের হাতে রয়েছে। নিয়োগপত্রে বলা হয়, পরবর্তী আদেশ না হওয়া পর্যন্ত তাদের নিয়োগ কার্যকর থাকবে। কিন্তু এতদিন পর্যন্ত কোনো কাজ না থাকায় এবং বেতন-ভাতা বন্ধ থাকায় নিয়োগপ্রাপ্তরা তাদের পদে রয়েছেন কি-না, তা নিয়ে রয়েছেন দ্বিধায়।
২০১৯ সালের জুলাই মাস থেকে কোনো বেতন-ভাতা পাচ্ছি না, কিন্তু এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি
বেতন-ভাতা বন্ধ থাকা এই ছয় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হলেন- মো. গোলাম মোস্তফা, খোন্দকার বশীর আহমেদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ মোস্তফা জামাল, রাফি আহমেদ, মো. মনোয়ার হোসেন ও একেএম দাউদুর রহমান মিনা। প্রয়াত সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের সময় ২০১৮ সালে ৪ জানুয়ারি তাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল।
এই ছয় আইন কর্মকর্তার মধ্যে পাঁচজন তাদের বকেয়া বেতনের দাবিতে গত ১৯ জানুয়ারি বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিনের কাছে আবেদন করেন। আবেদনগুলো আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটরের কার্যালয়েও পাঠানো হয়েছে। তাদের মধ্যে একেএম দাউদুর রহমান মিনা এই আবেদন করেননি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, আমি তাদের জমা দেয়া আবেদন পেয়েছি এবং সেগুলো আমি মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রেরণ করেছি। এখন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
আর আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক জানান, বিষয়টি সমাধানে কী করা যায় তা তিনি দেখবেন।
২০১৮ সালের ৪ জানুয়ারি ওই ছয়জনসহ ৩৪ জনকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি) নিয়োগ দিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর (ভারপ্রাপ্ত) রঞ্জন কুমার সাহা তখন একটি গেজেট জারি করেন। তারপর থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত সবাই অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই ৩৪ জনকে নিয়োগের আগে ২০১৭ সালের ২৬ জুন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ২০১৩ সালের আগে নিয়োগপ্রাপ্ত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি) এবং সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলদের (এএজি) পদত্যাগের জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল, ১০ বা ততোধিক বছরের বেশি সময় ধরে যারা ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল পদে আছেন কেবল তারাই পদত্যাগ করবেন। কিন্তু এর কম সময় ধরে যারা নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে কাজ করেছেন তাদের পদত্যাগ করার প্রয়োজন নেই। পরে ৮৭ জন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি) এবং সহকারী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (এএজি) আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে তাদের পদত্যাগপত্র জমা দেন। তখন সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, নির্দেশনাটি ২০১৮ সালের ৪ জানুয়ারির নিয়োগপ্রাপ্তদের জন্য প্রযোজ্য হবে না।
ওই ৩৪ জনের নিয়োগের আগে ২০১২ সালের ২১ জুলাই আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য ৭০ আইনজীবীকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এর মধ্যে ৩১ জনকে পুনরায় নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, অর্থাৎ তারা আরও আগে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। আর সাতজন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল পদ থেকে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। বাকিরা নতুন নিয়োগ পেয়েছিলেন।
কথা বলে জানা যায়, ২০১৮ সালের ৪ জানুয়ারি নিয়োগপ্রাপ্ত ৩৪ জনের মধ্যে মো. গোলাম মোস্তফার নাম এসএম গোলাম মোস্তফা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে তার বাবার নাম, ঠিকানা এবং হাইকোর্টের আইনজীবী হওয়ার তারিখ সবই ঠিক ছিল। অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে তার যোগদানের চিঠিও গ্রহণ করে। যোগদানের তিনদিন পর তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তাকে বিষয়টি সমাধানের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। সে অনুযায়ী তিনি মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগও করেছিলেন। কিন্তু কোনো সমাধান মেলেনি।
করোনা মহামারির মধ্যে ২০২০ সালে ২৭ সেপ্টেম্বর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম মারা যান। তিনি ২০০৯ সালে অ্যাটর্নি জেনারেল নিযুক্ত হয়ে ১১ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই পদে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এরপর গত বছরের ৮ অক্টোবর সরকার সিনিয়র আইনজীবী এবং সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এএম আমিন উদ্দিনকে দেশের ১৬তম অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেয়।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগ পাওয়া মো. গোলাম মোস্তফা জানান, তিনি আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছে নাম পরিবর্তন এবং ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে কাজ করার অনুমতির জন্য আবেদন করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি আইনমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ করেছি, তবে এখনো আমার নাম সংশোধন করা হয়নি। সুতরাং আমার নিয়োগের পরে আমি দায়িত্ব পালনে অংশ নিতে পারিনি। আশা করি এটি ওনারা দেখবেন।’
খোন্দকার বশীর আহমেদ বলেন, ‘আমাকে ২০১৪ সালের ৪ জানুয়ারিতে ডিএজি নিযুক্ত করা হয়েছিল। এজন্য আমাকে অফিস থেকে পদত্যাগ করতে বলা হয়নি বা আইনজীবীর কার্যালয় থেকে কোনো ডিসচার্জ নোটিশ পাইনি। তাই আমি এখনো পদে বহাল রয়েছি।’
রাফি আহমেদ বলেন, ‘আইন মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালের আগে নিয়োগপ্রাপ্ত ডিএজি এবং এএজিকে পদ থেকে পদত্যাগ করতে বলেছিল, সেখানে বলা হয়েছিল যারা ১০ বছর বা তার বেশি সময় ধরে কাজ করছেন তাদের বিষয়ে। সে হিসেবে আমরা দেড় বছরের (২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে বেতন-ভাতা বন্ধের আগ পর্যন্ত) মতো কাজ করেছি। তবে আমাদের ২০১৮ সালের ৪ জানুয়ারিতে নিয়োগ দেয়ার পর আইন মন্ত্রণালয় থেকে এখন পর্যন্ত পদত্যাগ করতে বলা হয়নি।’
‘কিন্তু চাকরিতে থাকলেও আমরা ২০১৯ সালের জুলাই মাস থেকে কোনো বেতন-ভাতা পাচ্ছি না। কাজও করার সুযোগ নেই। এখন আমরা পদে থেকেও নেই। কিন্তু এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। আমরা কাজ করবো কি-না, যদিও নিয়োগপত্রের জন্য জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা আছে পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত এই পদে থাকবো’— বলেন রাফি আহমেদ।
ক্ষোভ প্রকাশ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ মোস্তফা জামাল বলেন, ‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল পদে কাজও করেছি। আমাদের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই, আমরা এই পদে আছি কি-না, কোনো সিদ্ধান্ত না দিয়ে এভাবে পদ নিয়ে বসে থাকা লজ্জার। তাই আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখবেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘আমার কাছে তাদের (পাঁচজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল) আবেদন জমা দেয়া হয়েছে। সেটি আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। এ বিষয়ে এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পরবো না। তবে, তারা পদে আছেন কি-না সে বিষয়ে আশা করি মন্ত্রণালয় নিশ্চয় ব্যবস্থা নেবেন বা জানাবেন।’
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘তাদের (ছয়জন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল) বিষয়টি অফিসে গিয়ে দেখবো। খোঁজ-খবর নিয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’