জাতিসংঘের ৭৮তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের জন্য আমার সরকারের যুগান্তকারী উদ্যোগ ‘আশ্রয়ণ’। এই প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত প্রায় ৮ লাখ ৪০ হাজার পরিবারের প্রায় ৫০ লাখ মানুষকে বিনামূল্যে জমি ও ঘর বিতরণ করা হয়েছে। খবরটি শুনে মুহূর্তেই করতালি দিয়ে অভিবাদন জানান অধিবেশনে যোগ দেওয়া বিশ্বনেতারা। ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষের জন্য বিনামূল্যে ঘর দেওয়ায় বিভিন্ন সময় বহির্বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কারণ, বিশ্বে প্রায় অর্ধ কোটি মানুষকে বিনামূল্যে স্থায়ী ঠিকানার বন্দোবস্ত করার ঘটনা বিরল। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে যে, মানুষের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনে আশ্রয়ণ প্রকল্প একটি ‘মডেল’। যার ফলে দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্তির হার কমিয়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) শর্ত পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের আশ্রয়ণ প্রকল্পে স্ত্রীসহ বাস করছেন ৭২ বছর বয়সী আবুল বাশার। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে শরীর। তারপরও নিজ ঘরের বারান্দায় বসে থাকেন তৃপ্তি নিয়ে। মাথার ওপর ছাদটা দেখেন ঘুরেফিরে। হাসিমুখে তিনি জানালেন, এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, তার একটা ঘর আছে। বারান্দায় বসে আবুল বাশার এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘কোনোদিন ভাবি নাই ঘর অইবো, ঘরে জানডা বাঁচে।’ এরপরই দু’হাত তুলে বলেন, ‘আল্লাহ তুমি শেখ হাসিনারে দেইখ্যা রাইখো।’
প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেয়ে কেউ কেউ বলেছেন, ‘বাবা মা যা করেনি, শেখ হাসিনা তা করেছেন।’ আবার অনেকে এও বলেছেন, ‘আমরা এতদিন জলে ছিলাম। পরের জায়গায় পলিথিন দিয়ে ঘর বানিয়ে থাকতাম। এতে আমাদের খুব কষ্ট হতো। এখন আমরা ঘর পেয়েছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের ঘর দিয়েছেন। এখন আমাদের আর কষ্ট নেই। আমরা খুব খুশি। আমরা প্রধানমন্ত্রীর জন্য দোয়া করি।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু ঘর উপহার দেননি। তাদের জীবনমান উন্নয়নে দেওয়া হয়েছে পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও ঋণ। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছে গরুর খামার এবং দেওয়া হয়েছে সেলাই মেশিনের কাজ। এছাড়া হাঁস-মুরগি, কবুতর পালন ও শাকসবজি উৎপাদনসহ কৃষি কাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
শুধু গৃহহীন-ভূমিহীন নয়, সমাজে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকেও দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর। এর মধ্যে মান্তা, বেদে ও হিজড়া সম্প্রদায়, কুষ্ঠ রোগীদের জন্য রংপুরে বান্দাবাড়ী আশ্রয়ণ প্রকল্প, তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিবারের জন্য বিশেষ নকশার ঘর, দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলায় কয়লা খনির জন্য ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পুনর্বাসন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী (রাখাইন) পরিবারের জন্য বিশেষ নকশার টং ঘর নির্মাণ, ভিক্ষুক পুনর্বাসন, হরিজন সম্প্রদায়, বাগদী সম্প্রদায়, প্রতিবন্ধী পরিবার, জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারকে ঘর করে দেওয়া হয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৯৯৭ সালের ১৯ মে কক্সবাজার ও সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই বছরের ২০ মে ঘূর্ণিঝড় কবলিত কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার সেন্ট মার্টিন পরিদর্শন করেন এবং ঘূর্ণিঝড়ের শিকার গৃহহীন ও ছিন্নমূল পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করেন। তার নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় একজন আওয়ামী লীগ নেতার দান করা জমিতে পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করা হয়। ঘূর্ণিঝড় ও নদী ভাঙণের শিকার ভূমিহীন, গৃহহীন ও ছিন্নমূল পরিবারের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ‘আশ্রয়ণ’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের আওতায় এখনও পর্যন্ত প্রায় সাড়ে আট লাখ পরিবারের অর্ধকোটি মানুষকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিমানবন্দর-সংলগ্ন এলাকায় বসবাসরত জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের নির্দেশনা দেন। সে নির্দেশনা অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কক্সবাজার জেলার সদর উপজেলার খুরুশকুল মৌজায় ২৫৩ দশমিক ৫৯ একর জমিতে খুরুশকুল ‘বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। এ প্রকল্পের আওতায় সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ৫ তলা বিশিষ্ট ১৩৯টি বহুতল ভবন নির্মাণ করবে, যেখানে ৪ হাজার ৪০৯টি জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে। ইতোমধ্যে সেখানে ১৯টি ভবনে আশ্রয় নিয়েছে চার হাজার পরিবার। এখন আরও ৬০টি ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে। আগামী দুই মাসের মধ্যে এখানে আরও আড়াই থেকে তিন হাজার পরিবার আশ্রয় পাবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পর্যটন জোন ও শুঁটকি মহাল তৈরির মাধ্যমে প্রকল্পটি আরও টেকসই করা হচ্ছে। পুনর্বাসিত পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক সচ্ছলতা নিশ্চিত করার জন্য প্রশিক্ষণ ও ঋণ দেওয়া হচ্ছে। খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ একক জলবায়ু উদ্বাস্তু পুনর্বাসন প্রকল্প। এই প্রকল্পে বসবাসকারীদের সব ধরনের নাগরিক সুবিধা ও পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। তাছাড়া, সাইক্লোন সেন্টার, সোলার প্যানেল, রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং স্থাপনসহ সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা হচ্ছে।
প্রকল্প পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আফজাল হোসেন জানান, প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে ২০টি ভবন নির্মিত হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। পুনর্বাসিত পরিবারের জীবিকার সুবিধার্থে আধুনিক শুঁটকি মহাল, জীবনমান উন্নয়নের জন্য ৯৫ একর জায়গার ওপর ‘শেখ হাসিনা টাওয়ার’ স্থাপন ও তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে কর্মক্ষম করে গড়ে তোলার পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, ফ্ল্যাট হস্তান্তর ও রক্ষণাবেক্ষণের সুবিধার্থে আলাদা নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এছাড়া উপকারভোগীদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ফাঁড়ি, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন ও বাফার জোন স্থাপন করা হবে।
আশ্রয়ণ প্রকল্পে সৃজনশীল কর্মের মেধাস্বত্বের স্বত্বাধিকারী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ‘আশ্রয়ণ: অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে শেখ হাসিনা মডেল’কে সৃজনশীল মেধাকর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মোহাম্মদ তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া বলেন, ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প বিশ্বের মধ্যে একটি অনন্য প্রকল্প। কারণ, পৃথিবীর আর কোনও দেশে এত বিপুলসংখ্যক ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের মাঝে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ঘর বিতরণ করা হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার শুধু খাসজমিতে প্রকল্পের জন্য ঘর নির্মাণ করছে না, এর জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কাছ থেকে জমি কেনা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকেও অনুদান পাওয়া যাচ্ছে।’
এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ ভূমিহীন-গৃহহীন পুনর্বাসিত জেলা ২১টি ও উপজেলা হচ্ছে ৩৩৪টি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুসারে সমগ্র দেশকে ভূমিহীন-গৃহহীনমুক্ত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য সারাদেশে জমি কেনার পাশপাশি উদ্ধার করা হয়েছে খাস জমি। সারা দেশে উদ্ধারকৃত খাস জমির পরিমাণ প্রায় ৬ হাজার ২০০ একর, যার স্থানীয় বাজার মূল্য ৩ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা। এছাড়া সারা দেশে ৩২৩ দশমিক ৭৮ একর জমি কিনে ঘর করে দেওয়া হয়েছে। জমি কিনতে খরচ হয়েছে প্রায় ২১৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।
বিএসডি/এমএম