সাজেদুল হক-
সেদিনও আকাশে মেঘ ছিল। ঝিরঝিরে বৃষ্টি। সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে খবর এলো হুমায়ূন নেই। নেই মানে আসলেই নেই। মানুষের অসীম ক্ষমতার প্রতি বিশ্বাস ছিলো তার। লাখ লাখ ভক্তও বিশ্বাসে ছিলেন তিনি ফিরে আসবেন। কিন্তু তার আর ফেরা হলো না। ফিরে এলো প্রিয় হুমায়ূন আহমেদের লাশ। বাংলা সাহিত্যের মুকুটহীন সম্রাট শহীদ মিনারে। আকাশের কান্নাকে উপেক্ষা করে লাখ মানুষের স্রোত সেদিকে। আমরা শিরোনাম করেছিলাম, একটি কফিনের পাশে বাংলাদেশ। পৃথিবীর খুব কম সাহিত্যিকের ভাগ্যেই এমন শিরোনাম জুটেছিলো।
সব পরিচয় ছাপিয়ে হুমায়ূন পরিণত হয়েছিলেন জীবনশিল্পীতে। সমালোচনার বান উপেক্ষা করে লিখে গেছেন অবিরাম। দুঃসময়েও গেয়েছেন জীবনের জয়গান। অন্ধকার তার লেখায় সেভাবে আসেনি। তিনি ছিলেন আলোর পূজারি। যা তাকে এনে দেয় বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকের অভিধা। চাঁদনি রাতে চন্দ্রকারিগরের কাছে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। জীবনে সঞ্চিত সব ব্যথার কথা ভেবে কাঁদতে চেয়েছিলেন। ক্যালেন্ডারে ১৯শে জুলাই ২০১২। কালো অন্ধকার গ্রাস করে তাকে। মৃত্যুকালে মানুষ হুমায়ূন আহমেদের বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর আর লেখক হুমায়ূন বাংলাদেশ রাষ্ট্রেরই সমবয়সী ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলে যাত্রা শুরু হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের এক নতুন অধ্যায়ের। নন্দিত নরকের লেখক এরপর এগিয়ে যান ক্রমান্বয়ে। তিনি যেন রূপকথার সে রাজপুত্র- যখন যেখানে হাত দিয়েছেন সেখানেই সোনা ফলেছে। ৩২৩টির বেশি গ্রন্থে হুমায়ূন বয়ান করেছেন মধ্যবিত্ত বাঙালির সুখ-দুঃখ, হাসি আর আনন্দ-বেদনার কাহিনী। মনেপ্রাণে অসাম্প্রদায়িক হুমায়ূনের লেখায় ধর্মও উপেক্ষিত ছিল না। পবিত্র ধর্মগ্রন্থের বহু বাণি খুঁজে পাওয়া যাবে তার লেখায়। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পিতার সন্তান জোছনা আর জননীর গল্প লিখে শোধ করেছেন মাতৃভূমির ঋণ। নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ জনপ্রিয়তায় ছাড়িয়ে যান কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদকেও। বাকের ভাইয়ের স্রষ্টা চীরদিনই বেঁচে থাকবেন। ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে বিতর্কও ছিল। বিশেষ করে গুলতেকিনের সঙ্গে বিচ্ছেদ আর শাওনের সঙ্গে বিয়ে নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা হয় তার। চন্দ্র কারিগরের কাছে কেমন আছেন হুমায়ূন আহমেদ। তিনি কি সত্যি হারিয়ে গেছেন। না মিসির আলী, হিমু, রূপা, শুভ্রের বেশে জোছনা রাতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এখানে-সেখানে। ভক্তরা গভীর রাতে জোছনা অথবা তীব্র রোদে খুঁজে বেড়ায় তাদের প্রিয় মানুষটিকে। নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে।
হুমায়ূনের অপেক্ষা উপন্যাসের একটি চরিত্র সুপ্রভা। অভিমান করে যে আত্মহত্যা করে। তাকে নিয়ে হুমায়ূন লিখেছেন, ‘ছোট্ট সুপ্রভা। তোমার প্রসঙ্গ অপেক্ষা উপন্যাসে আর আসবে না। কারণ, তোমার জন্য কেউ অপেক্ষা করে থাকবে না। মৃত মানুষদের জন্য আমরা অপেক্ষা করি না। আমাদের সমস্ত অপেক্ষা জীবিতদের জন্য। এই চরম সত্যটি না জেনেই তুমি হারিয়ে গেলে।’
নুহাশপল্লীতে হুমায়ূনের কবরে কখনও যাওয়া হয়নি। এর একটা কারণ হয়তো এই- আমাদের মননে তিনি এখনও অমৃত। আমরা এখনও তাকে খুঁজিয়া বেড়াই।
লেখক- সাংবাদিক