নিজস্ব প্রতিবেদক:
এসব পরামর্শের বিপরীতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আবারও রাজনৈতিক সমঝোতার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না হলে, একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হলে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা দুরূহ হয়ে পড়বে। বড় দল নির্বাচন থেকে দূরে থাকলে অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনে কিছুটা ভাটা পড়তে পারে।
সংলাপ শেষে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, তাঁরা ৩০ জনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। অনেকের সমস্যা থাকা স্বাভাবিক। অংশগ্রহণ আরও বেশি হলে তাঁরা খুশি হতেন। তিনি বলেন, দলীয় ও নির্দলীয় সরকার নিয়েও সংলাপে বক্তব্য এসেছে। তবে নির্বাচন করতে হলে নির্দলীয় সরকার লাগবে—এমন বক্তব্য সবাই দেননি। দু–একজন হয়তো এ ধরনের বলেছেন।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে এই সংলাপ হয়। সভাকক্ষের বাইরে টিভি মনিটরে আলোচনা সরাসরি দেখা ও শোনার ব্যবস্থা ছিল সাংবাদিকদের জন্য। সংলাপে সিইসির সঙ্গে ছিলেন নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবীব খান, রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমান। সংলাপে ইসির পক্ষ থেকে সেভাবে সঞ্চালকের ভূমিকায় কেউ ছিলেন না। কার পরে কে বক্তব্য দেবেন, সেটিও ঠিক করে দেননি কেউ। শিক্ষকেরা নিজেদের মতো করে একজনের পর একজন বক্তব্য দিয়েছেন।
‘গালি খেতে হবে’
সংলাপে অংশ নিয়ে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ‘আপনারা যত যত্ন করেই কাজ করেন না কেন, আমি শিউর (নিশ্চিত) গালি খেতে হবে। লোকজন অনেক কিছু বলবেই। তবে দিন শেষে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যদি আপনারা বলতে পারেন আমি অনেস্ট (সৎ) ছিলাম, কাজটা সঠিক করেছি। তাহলে কে কী বলেছে, তা মাইন্ড করবেন না, তাহলেই হবে।’
দলীয় সরকারের অধীনে ভালো নির্বাচন করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার। এই নির্বাচন কমিশন গঠনপ্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, অনুসন্ধান কমিটি ১০-২০ জনের নাম প্রকাশ করলে ভালো হতো। এখন যেভাবে কমিশন হয়েছে, তা লুকোচুরি, ছলচাতুরী ও দুরভিসন্ধিমূলক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হয়েছে, এমনটি বলা যায়।
অধ্যাপক ইয়াহ্ইয়া আখতার বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করা যাচ্ছে না, এটা একাধিকবার দেখা গেছে। ইভিএম ব্যবহার করতে হলে তার আগে গণভোট করতে হবে। মানুষ যদি চায় তাহলে এটি ব্যবহার করা যাবে। তিনি বলেন, ভারতে অনেক জায়গায় ইভিএম নিয়ে মামলা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের ২৪টি অঙ্গরাজ্য ইভিএম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারা প্রযুক্তিসমৃদ্ধ দেশ।
২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে ইয়াহ্ইয়া আখতার বলেন, ‘প্রত্যেক জিনিসের একটা খাওয়ার ওয়াক্ত আছে। আপনি সকাল আটটার সময় খেলে এটাকে ব্রেকফাস্ট বলতে হবে। একটার সময় খেলে সেটাকে ব্রেকফাস্ট বললে হবে না, লাঞ্চ বলতে হবে। ভোটের বাক্সেরও একটা খাওয়ার সময় আছে। সেটা সকাল আটটা। কী হয়েছে লাস্ট ইলেকশনে? সে তো সাহ্রি খেয়েছে। সে তো ব্রেকফাস্ট খায়নি। এ রকম নির্বাচন করলে হবে না। এ রকম নির্বাচন আমরা চাই না।’
ইভিএম আরও সংস্কার করার সুযোগ আছে বলে সংলাপে উল্লেখ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম আনোয়ার হোসেন।গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জরুরি বলে মত দেন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির উপাচার্য আবদুল মান্নান চৌধুরী। নির্বাচন কমিশনকে কাজের মাধ্যমে আস্থা অর্জন করতে হবে বলে উল্লেখ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক আখতার হোসেন।
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির ওপর জোর দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান বলেন, ইসিকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে, প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখতে হবে। ক্ষমতাসীন দল আর প্রশাসনকে এক করা যাবে না। প্রয়োজনে একাধিক দিনে জাতীয় নির্বাচনে ভোট গ্রহণ করার পরামর্শ দেন তিনি।
একটি বড় রাজনৈতিক দল প্রায় সবকিছুতে ‘না’ বলছে বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনকে তাদের জন্য ‘স্পেস’ করে দিতে হবে। বারবার তাদের আমন্ত্রণ জানাতে হবে।
ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির উপাচার্যের প্রতিনিধি হিসেবে সংলাপে অংশ নেন বিশ্ববিদ্যালয়টির সহ–উপাচার্য নিয়াজ মোহাম্মদ খান। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থার সংকট আছে। ভোটারদের মধ্যে নির্বাচনবিমুখতা তৈরি হয়েছে।
এর আগে সংলাপের শুরুতে সিইসি হাবিবুল আউয়াল বলেন, আগের জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিভিন্ন কারণে হয়তো পুরো অংশগ্রহণমূলক হয়নি। তাঁরা চান আগামী নির্বাচন যেন অধিক অংশগ্রহণমূলক হয়। সংলাপের শেষ পর্যায়ে তিনি বলেন, ভালো নির্বাচন করাটা পুরোপুরি নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করে না। নির্বাচনে রাজনৈতিক আবহ অনুকূল না হলে, দলগুলোর মধ্যে মোটামুটি সমঝোতা না থাকলে, পক্ষগুলো খুব বেশি বিবদমান হয়ে গেলে ভালোভাবে নির্বাচন করাটা দুরূহ। রাজনৈতিক সমঝোতা গুরুত্বপূর্ণ। সমঝোতা হলে ইসির কাজ সহজ হবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ভোটের তিন মাস আগে ইসির নিয়ন্ত্রণে আনা প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, এটা বোধ হয় পুরোপুরি আনা হয় না। এটা হয়তো ইসিকে আইনিভাবে ক্ষমতা দেওয়া আছে সীমিতভাবে করার।
ইভিএমের ব্যবহার প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, ইভিএম নিয়ে তাঁরা আরও ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করবেন, এখানে সমস্যা আছে কি না।
বেলা তিনটা থেকে প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী এ সংলাপে অন্যদের মধ্যে সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক এ এফ এম মফিজুল ইসলাম, অধ্যাপক এম আবুল কাশেম মজুমদার, অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, অধ্যাপক লায়লুফার ইয়াসমীন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান সংলাপে অংশ নেন।
বিএসডি/ এফএস