আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি পুতিনের নির্দেশে রুশ সেনাবাহিনী ইউক্রেনে সর্বাত্মক হামলা শুরু করলে প্রথমে চীন এই ইস্যুতে অনেকটা নীরব থাকে। বিশ্লেষকদের মতে, বেইজিং শুরুর দিকে পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে। পশ্চিমারা রুশ হামলার প্রতিক্রিয়ায় পাল্টা ব্যবস্থা কী নেয়, সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখে বেইজিং। তবে দিন যত গড়াচ্ছে, এ বিষয়ে চীন নড়েচড়ে বসছে। ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চীন তার অবস্থান জোরদার করার চেষ্টা করছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ পুতিনকে সামলাতে, ইউক্রেনে রুশ হামলা বন্ধ করে শান্তি ফেরাতে সবচেয়ে কার্যকর মধ্যস্থতাকারী হতে পারেন সি। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের পথ দেখাতে পারে চীন।
রাশিয়ার অন্যতম বাণিজ্য অংশীদার চীন। গত বছর দেশ দুটির মধ্যে রেকর্ড ১৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য হয়েছে।ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার বিরুদ্ধে যখন একের পর এক পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে, তখন রুশ তেল-গ্যাসের অন্যতম রপ্তানি গন্তব্য হিসেবে ভাবা হয়েছে চীনকে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এখন মস্কো ও বেইজিং ঘনিষ্ঠ মিত্র। চীন ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্ক জোরালো হওয়ার বড় কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উভয়ের উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক। তাই পুতিন ইউক্রেনে হামলার অভিপ্রায় চীনকে আগে থেকে জানাননি, এটা মানতে নারাজ অনেকে।
সম্প্রতি পশ্চিমা গোয়েন্দাদের একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, সি সবই জানতেন। এমনকি শীতকালীন অলিম্পিক শেষ হওয়ার আগে যাতে রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক অভিযানে না যায়, মস্কোকে সে কথা বলেছিলেন চীনা কর্মকর্তারা। আর রাশিয়া সে কথা রেখেছে।
এসব দাবির সত্য-মিথ্যা যাচাই করার সুযোগ আপাতত নেই। তবে প্রকাশ্যে যা কিছু ঘটে চলছে, তা বিশ্লেষণের সুযোগ আছে।
ইউক্রেনে পুতিনের হামলার নিন্দা জানায়নি চীন। এমনকি ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানকে ‘আগ্রাসন’ পর্যন্ত বলতে নারাজ বেইজিং।
ইউক্রেন ইস্যুতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আনা নিন্দা প্রস্তাবে রাশিয়ার বিপক্ষে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে স্থায়ী সদস্য চীন।
ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুর দিকে এমনই ছিল চীনের অবস্থান।
ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরুর আগে থেকেই এ সংকটের সমাধানে ইউরোপীয় নেতাদের সরব থাকতে দেখা যায়। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এড়াতে তোড়জোড় চালান। হামলা শুরুর পরও তাঁদের তৎপরতা দেখা যায়। মধ্যস্থতার প্রচেষ্টায় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটও যোগ দেন।
তবে প্রথম দিকে ‘নীরব’ থাকা চীনের প্রকাশ্য তৎপরতা দেখা যায় চলতি মাসের শুরুর দিকে। ৬ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। তিনি ব্লিঙ্কেনকে জানান, আগুনে ঘি ঢালার যেকোনো পদক্ষেপের বিরোধিতা করবে চীন। এ ফোনালাপ নিয়ে একটি বিবৃতি দেয় চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, চলমান সংকট কেবল আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যেতে পারে। রাশিয়ার সঙ্গে ‘ন্যায্য আলোচনা’ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি আহ্বান জানায় বেইজিং।
ইউক্রেন সংকট সমাধানে ৮ মার্চ জার্মানির চ্যান্সেলর শলৎজ ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাখোঁর সঙ্গে ভার্চ্যুয়ালি বৈঠক করেন সি। এ সময় তিনি ইউক্রেন ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে একযোগে ও সক্রিয়ভাবে কাজ করার পাশাপাশি সংকট সমাধানে মধ্যস্থতায় আগ্রহের কথা জানান।
বৈঠকের পর চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, ইউক্রেন পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলেছেন সি।
ফরাসি প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছাতে জার্মানি ও ফ্রান্সের উদ্যোগে সমর্থন দিয়েছেন চীনা প্রেসিডেন্ট।
এ পরিস্থিতিতে বিবিসির এক প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়, ইউক্রেন ইস্যুতে নীতি বদলাচ্ছে বেইজিং। তার কারণ হলো রাশিয়ার পাশাপাশি ইউক্রেনও চীনের মিত্র দেশ।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর ঘনিষ্ঠ। তারপরও তিনি সির উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) ইউক্রেনকে যুক্ত করেছেন।
প্রতিবছর চীন ও ইউক্রেনের মধ্যে বিপুল অর্থের বাণিজ্য হয়। ইউক্রেনের অবকাঠামো খাতে চীনা বিনিয়োগ রয়েছে। এসব কারণে চলমান সংকটে পুতিনের মনরক্ষার পাশাপাশি চীনকে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ানোর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে পরাশক্তি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে পছন্দ করে চীন। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির এই দেশটি জলবায়ু পরিবর্তন থেকে শুরু করে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা বিষয়ে সরব ভূমিকা পালন করছে।
এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোকে নিজের প্রভাব বলয়ে আনতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বেইজিং।
ঐতিহাসিকভাবে পশ্চিমাবিরোধী অবস্থান চীনের। এসব কারণে ইউক্রেন ইস্যুতে চাইলেও নীরব থাকতে পারবে না বেইজিং। আর ইউরোপে একটি দীর্ঘ যুদ্ধ দেখতে চাইছে না চীন। তাই ইউক্রেন সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে মধ্যস্থতায় আগ্রহী চীন।
এ ক্ষেত্রে চীনের ‘পশ্চিমা ভীতি’ একটা ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন অনেকে। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা পশ্চিমা দেশগুলোকে এক জোট করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পশ্চিমাদের মধ্যে এমন ঐক্য দেখা যায়নি। তাদের ফাটল ধরা সম্পর্কে নতুন গতি এসেছে। এটা চীনের নজর এড়ায়নি।
একইভাবে ইউক্রেন ইস্যুতে চীনের অবস্থানের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো। এ পরিস্থিতিতে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের সম্ভাব্য পরিণতি নিয়েও ভাবতে হচ্ছে চীনকে। বিশেষত তাইওয়ান, হংকং ও দক্ষিণ চীন সাগরের বিরোধ নিয়ে ভাবছে বেইজিং।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেলের একটি সাক্ষাৎকার গত শুক্রবার প্রকাশ করেছে স্পেনের একটি সংবাদপত্র। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ইউক্রেন ইস্যুতে যদি কেই মধ্যস্থতা করতে পারে, তবে চীনই পারবে। যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইইউ—কেউই বিবাদমান দুই পক্ষকে এক করতে পারবে না। এটা চীনের পক্ষেই সম্ভব।
পুতিনের সঙ্গে সির ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব’ এই মধ্যস্থতায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে বিবিসির বিশ্লেষণে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এ দুই নেতার ৩০ বারের বেশি সাক্ষাৎ হয়েছে। তাঁদের ক্ষমতাচর্চার কৌশল বেশ কাছাকাছি। দুজনই পশ্চিমাবিরোধী। এসব মিল ইউক্রেনের ওপর থেকে পুতিনের খড়্গ সরিয়ে আনতে সিকে সহায়তা করতে পারে। তাই চলমান সংকটে কার্যকর মধ্যস্থতাকারী হতে পারেন সি।
এ বিষয়ে সাংহাই ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের বিশ্লেষক ঝাও লং ‘সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, চলমান সংকট নিরসনে চীনের মধ্যস্থতা কার্যকর ফল আনতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং ইউক্রেনকে অস্ত্র ও সামরিক সহায়তা দেওয়ার কৌশল থেকে সরে আসতে হবে। তা না হলে সুফল মিলবে না।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের জার্মান মার্শাল ফান্ডের (জিএমএফ) এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ ফেলো অ্যান্ড্রু স্মলের মতে, ইউক্রেন ইস্যুতে মধ্যস্থতার জন্য চীন নিজ থেকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্র আপত্তি করবে না।
বিএসডি/ এফএস