নিজস্ব প্রতিবেদক:
দলের নির্দেশ অমান্য করে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, আওয়ামী লীগের এমন বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে কেন্দ্র। ভবিষ্যতে দলের কোনো পদ-পদবিতে রাখা হবে না, বিদ্রোহীদের মদদদাতাদের বিরুদ্ধেও সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে-এমন হুঁশিয়ারির পরও বিদ্রোহী প্রার্থীদের দমাতে পারছে না ক্ষমতাসীন দলটি। ইউনিয়ন পরিষদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থীদের চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন দলীয় মনোনয়ন না পাওয়া বিদ্রোহীরা। বিদ্রোহীদের নিয়ে এখন বিপাকে পড়েছে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ।
সূত্র জানিয়েছে, টানা একযুগ ক্ষমতায় থাকার ফলে সবার মধ্যে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা, কেন্দ্রে নাম পাঠানোর সময় স্বজনপ্রীতি, বিতর্কিত ব্যক্তিকে দলীয় মনোনয়ন, স্থানীয় রাজনীতিতে গ্রুপিং, বিরোধী দলগুলোর নির্বাচনের মাঠে না থাকা কারণ বলে মনে করেন দলের নেতারা। একই সঙ্গে সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এই বিদ্রোহীরা ‘সাধারণ ক্ষমা’ পাবেন এমন ধারণা থেকেও দলের বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। সে কারণে বিদ্রোহীদের দমানো যাচ্ছে না। একইভাবে বিদ্রোহীদের পেছনে দলীয় এমপি-মন্ত্রী ও নেতাদের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জাতীয় সংসদের হুইপ মো. আতিউর রহমান আতিকের বড় ভাই মো. ইসমাইল হোসেন সদর উপজেলার কামারের চড় ইউনিয়ন পরিষদে নৌকার বিপক্ষে নির্বাচন করছেন। তিনি বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। এখানে নৌকার প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান। বিদ্রোহী প্রার্থী মাঠে থাকলে নৌকার প্রার্থীর জন্য নির্বাচনে জয়ী হওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
রাজশাহী-১ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর চাচাতো ভাই খাদেকুন্নবী বাবু চৌধুরী তানোরের কলমা ইউপিতে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে মাঠে রয়েছেন যশোর-২ আসনের সংসদ সদস্য নাসির উদ্দিনের ভাই একেএম গিয়াস উদ্দিন। তিনি মাগুরা ইউপি থেকে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
বিদ্রোহী প্রার্থী ও তাদের মদদদাতাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ। তিনি বলেন, দল করলে সবাইকে দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে। ইউপি নির্বাচনে দল থেকে প্রার্থী দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে যারাই বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এই বিদ্রোহীদের পেছনে যারা মদদ দিচ্ছেন, নির্বাচনে কাজ করছেন যে বড় নেতাই হোন না কেন তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জানা গেছে, দ্বিতীয় ধাপে সারা দেশে ৮৪৮টি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ৯৪৬ জন ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। মঙ্গলবার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন মাত্র ২৫৫ জন মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন। বাকি ৬৯১ জন বিদ্রোহীই নির্বাচনে রয়ে গেলেন। অর্থাৎ ৮৪৮টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ৬৯১ জন। তবে ৮১ ইউনিয়নে প্রার্থী না থাকায় নৌকার প্রার্থীরা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলায় দ্বিতীয় ধাপে হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে স্বামী ও স্ত্রী আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করে তুমুল আলোচনায় আসেন এই দম্পতি। গত মঙ্গলবার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে স্ত্রী ওই ইউনিয়নের মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শিরিন আকতার নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু স্বামী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ফারুক মিয়া নৌকার প্রার্থীকে চ্যালেঞ্জ জানাতে ‘বিদ্রোহী’ হিসেবে মাঠে রয়েছেন।
নাটোর সদরের সাতটি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান প্রার্থী ১৯ জন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ছয়জন বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। বড়াইগ্রামের পাঁচ ইউপিতে চেয়ারম্যান প্রার্থী ১৪ জন। এর মধ্যে নয়জন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী। মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার চার ইউনিয়নে ১৫ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে ১১ জন নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থী। গাংনী উপজেলার পাঁচটি ইউপিতে ১৪ জন বিদ্রোহী প্রার্থীর কেউই মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। বগুড়া জেলায় দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচন হচ্ছে শেরপুর ও শিবগঞ্জ উপজেলায়।
শেরপুরে খানপুর ইউপিতে একজন বিদ্রোহী প্রার্থী আছেন। আর শিবগঞ্জের ২টিতে আছেন বিদ্রোহী প্রার্থী। এ দুই ইউনিয়ন হলো আটমুল ও বিহার ইউনিয়ন। বিদ্রোহী দমনে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে আওয়ামী লীগ কঠোর অবস্থান নিলেও তা আমলেই নেননি দলের তৃণমূলের নেতারা। অনেক বিদ্রোহী প্রার্থী বলেছেন, কেন্দ্র অযোগ্যদের প্রতীক দেবে। তারপরও তাঁরা কি বসে থাকবেন?
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, দলীয় পদ-পদবির চেয়েও অনেকের কাছে চেয়ারম্যান পদ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর সঙ্গে আর্থিক লাভ জড়িত। বর্তমান সরকার তৃণমূল পর্যায়ে উন্নয়ন করছে। স্থানীয় পর্যায়ে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এসব প্রকল্পের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের সংশ্লিষ্টতা থাকে। তাই অনেকেই দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হচ্ছেন। অন্যদিকে অতীতে যাঁরা বিদ্রোহী হয়েছিলেন, তাঁদের প্রাথমিকভাবে শোকজ করা হলেও পরে সাধারণ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। সে কারণে এবার দলের হুমকিকে তাঁরা তেমন গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন না। আবার স্থানীয় সংসদ সদস্য ও অন্য নেতারা নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে অনেকেই ‘নিজস্ব প্রার্থী’ দাঁড় করান। বিদ্রোহী প্রার্থীর নেপথ্যে যাঁরা থাকেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কখনই কিছু বলে না দল। এসব কারণে অনেকেই মনে করেন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে প্রার্থী হলে কোনো সমস্যা হবে না।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন, তারা হয়তো নিজেদের স্থানীয়ভাবে সবচেয়ে ‘জনপ্রিয়’ ও ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ভাবেন। আর অতীতে বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা করে দেওয়ায় এবারও বিদ্রোহীরা দলের প্রার্থীকে চ্যালেঞ্জ জানাতে সাহস পাচ্ছেন। এ ছাড়াও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কাউকে বহিষ্কার করা হবে না- এমন ধারণা থেকেও বিদ্রোহী প্রার্থী হতে পারেন। তবে যারাই দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করবেন, আমরা তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, নির্বাচনে বিরোধী দল না থাকায় তৃণমূলের অনেকেই প্রার্থী হন। তাঁরা মনে করেন, নির্বাচনে তো বিএনপি নেই। তাই নৌকার বিপক্ষে প্রার্থী হচ্ছেন। দলীয়ভাবে সমঝোতার চেষ্টা করা হলেও সেটা শুনতে চান না তাঁরা। আবার কিছু কিছু জায়গায় প্রতিযোগিতা ধরে রাখার জন্যও বিদ্রোহীদের বিষয়ে নমনীয় থাকেন স্থানীয় নেতারা।
বিএসডি/আইপি