এখন পর্যন্ত এবারের ইউরোর সেরা ম্যাচ কোনটি, সে প্রশ্নে আজ দিনের শেষ ম্যাচেই চোখ ফিরবে অনেকের। নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে রোমাঞ্চ ছড়ানো ম্যাচটা যে বারবার রঙ বদলেছে!
সাত মিনিটে দুই গোলে নেদারল্যান্ডস নিশ্চিত জয়ের পথে এগিয়ে যাচ্ছে বলে যখন ধরে নেওয়া হচ্ছিল, পাঁচ মিনিটে দুই গোল করে দারুণভাবে ম্যাচে ফিরেছিল ইউক্রেন। এরপর ম্যাচ যখন সমতায়ই শেষ হবে ধরে নেওয়ার সময় হয়ে এসেছিল, তখন আবার রঙ বদল।
শেষ পর্যন্ত বারবার রঙ বদলাতে দেখা ম্যাচটা ৩-২ গোলে জিতে ইউরোতে দারুণ শুরু হলো সাত বছর পর কোনো বড় আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে ফেরা নেদারল্যান্ডসের।
২০১৬ ইউরো ও ২০১৮ বিশ্বকাপে জায়গা করে নিতে না পারা ডাচদের জন্য আজকের রাতটা এমনিতেই বিশেষ ছিল, আমস্টারডামের ইয়োহান ক্রুইফ অ্যারেনায় ম্যাচটা সেটিকে আরও রাঙিয়ে দিল!
গোলশূন্য প্রথমার্ধের পর ম্যাচের পাঁচটি গোলই হয়েছে দ্বিতীয়ার্ধে। এই প্রথম ইউরোতে প্রথমার্ধে গোলশূন্য কোনো ম্যাচ দ্বিতীয়ার্ধে পাঁচ গোল দেখল।
৫২ থেকে ৫৮ – এই আট মিনিটে জর্জিনিও ভাইনালডাম ও ভাউট ভেগহর্স্টের দুই গোলে এগিয়ে গিয়েছিল নেদারল্যান্ডস। কিন্তু আন্দ্রেই শেভচেঙ্কোর অধীন ইউক্রেন ছেড়ে কথা বলেনি! ৭৫ মিনিটে আন্দ্রেই ইয়ারমোলেঙ্কোর চোখধাঁধানো গোলে ব্যবধান কমায়, সমতায় ফেরে চার মিনিট পর রোমান ইয়ারেমচুকের গোলে।
কিন্তু ম্যাচে রঙ বদলানোর তো তখনো বাকি! ম্যাচজুড়ে নেদারল্যান্ডসের বেশ কয়েকটি আক্রমণে বড় ভূমিকা রাখা রাইটব্যাক ডেনজেল ডুমফ্রিসের তখনো কিছু বলার ছিল। বললেন ৮৫ মিনিটে। সেন্টারব্যাক নাথান আকের ক্রস জালে জড়িয়ে আমস্টারডামের আংশিক দর্শকভরা গ্যালারিতে আনন্দের বান বইয়ে দেন ডুমফ্রিস।
ইয়োহান ক্রুইফ অ্যারেনায় ম্যাচের একাদশেই চমক উপহার দিয়েছেন নেদারল্যান্ডস কোচ ফ্রাঙ্ক ডি বোর। ৪-৩-৩ ছকের বদলে দলকে গত কিছুদিন ধরেই তো ৫-৩-২ ছকে খেলাচ্ছেন ডি বোর, সেখানে আজ রাখেননি জুভেন্টাসে খেলা সেন্টারব্যাক ম্যাটাইস ডি লিখটকেও।
অথচ চোটের কারণে দলের রক্ষণের মূল ভরসা লিভারপুলের ভার্জিল ফন ডাইক না থাকায় ডি লিখটই এবারের ইউরোতে নেদারল্যান্ডসের রক্ষণের প্রাণ হবেন বলে ভাবা হচ্ছিল। কিন্তু তাঁর জায়গায় নেদারল্যান্ডস কোচ নামালেন ইউরিয়েন টিম্বারকে।
কিন্তু ডি লিখটের অভাব তেমন বোধ করতে হয়নি নেদারল্যান্ডসকে। বরং উল্টো দিকে ম্যাচের প্রথম দশ মিনিটের মধ্যেই দারুণ তিনটি সুযোগ তৈরি করে বারবার দ্রুতগতিতে আক্রমণে ওঠা নেদারল্যান্ডস।
ম্যাচজুড়ে দারুণ খেলা মেম্ফিস ডিপাই দ্বিতীয় মিনিটেই মাঝমাঠ থেকে বল টেনে নিয়ে দুই ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে উঠে যান ইউক্রেন বক্সের সামনে, কিন্তু তাঁর বাঁ পায়ের শটে জোর ছিল না তেমন।
তিন মিনিট পর ভাইনালডামের থ্রু ধরে ডুমফ্রিস গোলপোস্টে শট নিলেও পোস্ট ছেড়ে বেরিয়ে আসা ইউক্রেন গোলকিপার ঝাঁপিয়ে ঠেকিয়ে দেন সেটি। সপ্তম মিনিটে আবার দ্রুতগতির পাল্টা আক্রমণের পর ডুমফ্রিসের কাটব্যাকে ভাইনালডাম শট নিয়েছিলেন, কিন্তু ১৫ গজ দূর থেকে তাঁর শট চলে যায় বার উঁচিয়ে।
তখন মনে হচ্ছিল, সাত বছর পর বড় মঞ্চে আসার ম্যাচটাতে নেদারল্যান্ডস আক্রমণে আক্রমণে উড়িয়ে দেবে ইউক্রেনকে। বল পায়ে না থাকলে মূলত ৪-৫-১ ছকে রক্ষণকাজ চালিয়ে যাওয়া ইউক্রেন সে সময় ভুগেছেও বেশ। কিন্তু কখনো নিজেদের ভুল আর কখনো ইউক্রেন গোলকিপারের দক্ষতায় গোল পাওয়া হচ্ছিল না নেদারল্যান্ডসের।
বারবার নেদারল্যান্ডসের আক্রমণ ঠেকিয়ে যাওয়া ইউক্রেনের হয়ে ৩৯ মিনিটে আবারও ত্রাতার ভূমিকায় গোলকিপার বুশচান, দারুণ দক্ষতায় ঠেকিয়ে দেন ভাইনালডামের শট। এক মিনিট পর আমস্টারডাম অ্যারেনায় হতাশা বাড়ে ডুমফ্রিসের মিসে। বাঁ দিক থেকে ডিপাইয়ের ক্রস এসেছিল, কিন্তু আশপাশে কেউ বাধা দেওয়ার মতো না থাকলেও ডুমফ্রিস হেড রাখতে পারেননি পোস্টে।
গোলশূন্য প্রথমার্ধের হতাশা অবশ্য বিরতি থেকেই ফিরে মিটিয়ে দেয় নেদারল্যান্ডস। বড় টুর্নামেন্টে নেদারল্যান্ডের সর্বশেষ গোলদাতা ভাইনালডামই সাত বছর পর আবার গোল করলেন! ২০১৪ বিশ্বকাপেও নেদারল্যান্ডসের সর্বশেষ গোলটি ভাইনালডামই করেছিলেন। আজকের গোলটি অবশ্য কিছুটা সৌভাগ্যপ্রসূত।
৫২ মিনিটে ডানদিক থেকে আবার ডুমফ্রিসের দারুণ দৌড়ের পর মাটি কামড়ানো ক্রস, উদ্দেশ্য মেম্ফিস ডিপাই। কিন্তু বল ডিপাইয়ের কাছে যাতে যেতে না পারে, সে জন্য এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়েছিলেন ইউক্রেন গোলকিপার। সে চেষ্টায় তিনি সফল, কিন্তু তাঁর হাতে লেগে বল চলে যায় বক্সের সামনের দিকে, দৌড়ে উঠে আসা ভাইনালডামের দিকে। ভাইনালডামের বাঁ পায়ের শট জড়াল জালে!
ছয় মিনিট পর আবার আমস্টারডামে উল্লাস। আবার ডুমফ্রিসের দৌড়, এবার তাঁর ক্রস সামলাতে গিয়ে ভুল ইউক্রেনের ডিফেন্ডার মাইকোলেঙ্কোর। পড়ে পাওয়া সুযোগটা হাফভলিতে জালে জড়ালেন ভেগহর্স্ট।
নেদারল্যান্ডসের জয় তখন ম্যাচের বিধিলিপি বলেই মনে হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত তা-ই হয়েছে। কিন্তু তখন কে জানত, এর আগে এত নাটক অপেক্ষায় আমস্টারডামে!
৭৫ মিনিটে আমস্টারডামকে বিস্ময় আর মুগ্ধতায় ভাসিয়ে ইউক্রেনকে ম্যাচে ফেরান ইয়ারমোলেঙ্কো। তরুণ প্রতিভাবান মিডফিল্ডার মালিনভস্কির সঙ্গে বল দেওয়া-নেওয়ার পর ২০ গজ দূর থেকে ইয়ারমোলেঙ্কোর শট, ঝাঁপিয়ে পড়লেও তা ঠেকানোর সাধ্য ছিল না নেদারল্যান্ডসের গোলকিপার স্টেকেলেনবার্গের। এখন পর্যন্ত ইউরোর সেরা গোলের ভোটে এই গোলই যে জিতবে, এ নিয়ে সংশয় সামান্যই!
ওই গোলের বিস্ময় কাটিয়ে উঠেই সারতে পারেনি নেদারল্যান্ডস, চার মিনিট পর আরও বড় ধাক্কা ইউক্রেনের! এবার মাঝমাঠের কিছুটা ওপরে ফ্রি-কিক পেয়েছিল ইউক্রেন। মালিনভস্কির দারুণ ক্রস এল নেদারল্যান্ডস বক্সে, দারুণ হেডে সেটি জালে জড়ান ইউক্রেন স্ট্রাইকার ইয়ারেমচুক। ম্যাচের তখন আর মিনিট দশেক বাকি।
কিন্তু ইউক্রেনের এভাবে ফিরে আসায় চমকে গেলেও বিবশ হয়ে যায়নি নেদারল্যান্ডস। ৮৫ মিনিটে এবার আলোটা পুরোপুরি নিজের ওপর নিয়ে নিলেন ডুমফ্রিস। বাঁ দিক থেকে আকের ক্রস এল ইউক্রেন বক্সে, দৌড়ে উঠে আসা ডুমফ্রিস গায়ের সঙ্গে লেগে থাকা ইউক্রেন মিডফিল্ডার জিনচেঙ্কোকে এড়িয়ে দারুণ হেড করলেন। ঝাঁপিয়ে পড়া ইউক্রেন গোলকিপারের নাগালের বাইরে থেকেই বল জড়াল জালে।