নিজস্ব প্রতিবেদক:
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কেনার জন্য ৮৭১১ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুমোদন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট নেওয়া হবে। সংসদ নির্বাচনে এ মেশিন ব্যবহার নিয়ে রাজনৈতিক মহলে তর্কবিতর্ক চলছেই।
এর মধ্যেই ‘নির্বাচনি ব্যবস্থায় ইভিএম ব্যবহার বৃদ্ধি এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় আরও দুই লাখ মেশিন কিনতে যাচ্ছে ইসি। সোমবার কমিশনের মুলতুবি সভায় এ সংক্রান্ত প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়। এখন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পরিকল্পনা কমিশনে পাঠাবে ইসি সচিবালয়। সোমবার কমিশন সভায় নেওয়া এসব সিদ্ধান্ত জানিয়েছে ইসি।
এ সিদ্ধান্তে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অপরদিকে ইসি সরকারের আজ্ঞাবহ, তার প্রমাণ দিচ্ছে বলে মন্তব্য বিএনপির।
জানা যায়, গতবারের চেয়ে এবারের ইভিএম কেনায় খরচ বেড়ে গেছে। ডলারের দাম বৃদ্ধিকে এর কারণ বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। প্রস্তাবিত ডিপিপিতে প্রতি ইভিএমের দাম ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৫ হাজার টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হবে ভ্যাটসহ আনুষঙ্গিক শুল্ক। অথচ ইসির হাতে বর্তমানে যে দেড় লাখ ইভিএম আছে, এর প্রতিটির দাম পড়েছিল ২ লাখ ৫ হাজার টাকা। এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক যন্ত্রাংশসহ দাম পড়েছিল ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এছাড়া এ প্রকল্পের আওতায় চারটি পাজেরো জিপ ও প্রতিটি উপজেলা এবং থানায় ইভিএম পরিবহণের জন্য পাঁচ শতাধিক পিকআপ কেনার টাকা ধরা হয়েছে। ইভিএম সংরক্ষণের জন্য ১০টি অঞ্চলে ওয়ারহাউজ নির্মাণ করা হবে। এ প্রকল্পে এক হাজার তিনশর বেশি জনবল ধরা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, চলমান দেড় লাখ ইভিএম কেনার প্রকল্পে ওয়ারহাউজ, জনবল ও গাড়ি কেনা হয়নি। নতুন প্রকল্পে এসব অনুষঙ্গ ধরায় সার্বিক ব্যয় বেড়েছে।
এ প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদনের কথা কমিশন সভার পর সাংবাদিকদের জানান নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর। এছাড়া নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকেও একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিষয়টি জানানো হয়। কমিশন সভার সিদ্ধান্তের বিষয়ে মো. আলমগীর বলেন, ‘আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বর্তমানে আমাদের কাছে যে ইভিএম আছে, তা দিয়ে সর্বোচ্চ ৭০ থেকে ৮০টি আসনে ভোট করা সম্ভব। তাই ১৫০টি আসনে নির্বাচন করতে হলে নতুন করে ইভিএম কিনতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এজন্য ইসি সচিবালয় নতুন একটি প্রকল্প প্রস্তাব কমিশন সভায় তুলেছিল। আমরা এটার অনুমোদন দিয়েছি। এখন পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে। এর আগে একটা কাজ আছে। সেটা হলো অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটা সভা করতে হবে। তারপর সেটা প্ল্যানিং কমিশনে পাঠানো হবে। একনেক এটা চূড়ান্ত অনুমোদন করবে কি করবে না, সেটা তাদের বিষয়।’
এদিকে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়ায় ইসির এ সিদ্ধান্তে সন্তুষ্টি জানিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. মাহবুবউল আলম হানিফ যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনে ইভিএম বা কাগজের ব্যালটে ভোটগ্রহণ নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পর জাল ভোট, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, কেন্দ্র দখলের মতো নানা অভিযোগ ওঠে। ইভিএমে ভোট হলে ওই অভিযোগ আসবে না। আওয়ামী লীগ তিনশ আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণের প্রস্তাব করেছিল। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। তারা তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের পদক্ষেপ নিয়েছে। ইসির এ সিদ্ধান্তে আমরা খুশি।
অপরদিকে সরকারি দলকে খুশি করতেই ইসি এ প্রকল্প নিয়েছে বলে মনে করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের সবাই সরকারের আজ্ঞাবহ। এদেরকে বসানোই হয়েছে সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে। তাই শুরু থেকেই এ কমিশনের প্রতি আমাদের আস্থা নেই। তিনি বলেন, বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের মতকে উপেক্ষা করে ইসি ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী নির্বাচনে সরকারের নীলনকশা বাস্তবায়নে এছাড়া তাদের বিকল্প ছিল না। বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটে এত টাকা খরচে এ প্রকল্প না নেওয়ার জন্য ইসিকে অনেকেই অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তারা কারও কোনো মতকেই তোয়াক্কা করছে না।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে সোমবার নির্বাচন ভবনে কমিশনের মুলতুবি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে চারজন নির্বাচন কমিশনার উপস্থিত ছিলেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সিইসি ভার্চুয়ালি সভায় অংশ নেন। এবারের সভায়ও প্রচলিত নিয়ম ভেঙে কয়েকজন যুগ্মসচিবকে রাখা হয়নি। এর আগে এ বিষয়ে গত মঙ্গলবার কমিশন সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ইসি সচিবালয় পূর্ণাঙ্গ ডিপিপি উপস্থাপন না করায় ওই সভা মুলতুবি করা হয়।
ইসি সচিবালয় সূত্র জানায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেড় লাখ ইভিএম কিনতে ৩৮২৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকার প্রকল্প নিয়েছিল তৎকালীন সিইসি কেএম নূরুল হুদা কমিশন। ওই প্রকল্পের আওতায় ৩৫১৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা ব্যয়ে দেড় লাখ ইভিএম সংগ্রহ করে ইসি। শেষ পর্যন্ত মাত্র ছয়টি আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণ হয়েছিল। ওই প্রকল্পের মেয়াদ আগামী জুনে শেষ হওয়ার সময় নির্ধারিত রয়েছে। এর মধ্যে নতুন প্রকল্প অনুমোদন দিল ইসি। চলতি বছরের নভেম্বর থেকে পাঁচ বছর প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে। যদিও ইসির সংলাপে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল বিপক্ষে মতামত দিয়েছিল। তবে নির্বাচন কমিশনের কর্মপরিকল্পনায় ওই মতামত পালটে ২৯টি দলের মধ্যে ১৭টি পক্ষে মত দিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর ইভিএমের বিরোধিতাকারী দলের সংখ্যা দেখিয়েছে ১২টি।
বিএসডি/এফএ