নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশে তাপমাত্রা বাড়ছে। এ কারণে বাড়ছে নানামুখী শঙ্কাও। বিজ্ঞানীরা বলছেন, যেভাবে প্রতি বছর দেশের তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে, তাতে ধান উত্পাদনে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে নানা গবেষণা ও কৌশল নিয়ে এগোচ্ছেন ধান বিজ্ঞানীরা।
তারা বলছেন, তাপের ক্ষতি থেকে ধানকে রক্ষায় আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। গবেষণার প্রস্তুতি শুরু হয় ২০১৩ সালে। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, আগামী বছরের মধ্যে গবেষণা শেষ পর্যায়ে এনে নতুন জাতের সুখবর দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া নতুন একটি কৌশলও খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ভোরে ফুল ফোটানোর মাধ্যমে ক্ষতির হাত থেকে ধান রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় জিনগুচ্ছও পাওয়া গেছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ধানের ফুল ফোটা ও পরাগায়ণের সময় এক থেকে দুই ঘণ্টা তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও বেশি হলে সাদা শিষ, সাদা স্পাইকলেট, শিষে স্পাইকলেটের সংখ্যা কমে যাওয়া এবং চিটা সমস্যার দরুন ধানের ফলন অনেক কমে যায়। এ থেকে রক্ষার জন্য নতুন কৌশলের পথে হাঁটছেন বিজ্ঞানীরা।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ড. সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ধানগাছে দিনে ফুল ফোটে। সাধারণত সকাল ১০টার পর। এ সময় তাপমাত্রা বেশি থাকে। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে ব্যাপক ফলন কমে। তাই ধানের ফুল যদি ভোরে ফোটানো যায়, তাহলে তাপের ক্ষতি থেকে ধান রক্ষা করা যায়। কারণ সকালে তাপমাত্রা কম থাকে।
এই ধানবিজ্ঞানী বলেন, ‘ওরাইজা গ্লাবেরিমা’ নামক বন্য প্রজাতির ধানের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যে জিনগুচ্ছের কারণে ঐ ধানে ভোরে ফুল ফোটে, সেই জিনগুচ্ছ এনে আমাদের দেশের ভালো কোনো জাতে ক্রস করা হবে। এতে আমাদের দেশের ধানে ভোরে ফুল ফুটবে। ফলে ফুল ফোটার সময় তাপের কারণে ক্ষতির হাত থেকে ধান রক্ষা করা যাবে। আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যেই এ বিষয়ে সুফল পাওয়া যাবে বলে জানান তিনি।
এছাড়া ধানের তাপ থেকে রক্ষার জন্য নতুন জাতের ধানও উদ্ভাবন করছেন বিজ্ঞানীরা। এই ধান নিয়ে গবেষণায় যুক্ত রয়েছেন ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুন্নুজান খানম। তিনি ইত্তেফাককে বলেন, বর্তমানে যে ধানের জাত রয়েছে, সেগুলো ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপ সহ্য করতে পারে। কিন্তু নতুন যে ধানের জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে, তা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপ সহ্য করে ভালো ফলন দিতে পারবে। তিনি জানান, বিশ্বে এর ওপরে তাপ সহ্য করে এমন কোনো জাত নেই।
গত বছর হাওরাঞ্চলে প্রবাহিত গরম হাওয়া বা ‘হিট শক’ কৃষিতে আঘাত হানে। এতে অন্তত ৪৮ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ আবাদ পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরোপুরি নষ্ট হয় ১০ থেকে ১২ হাজার হেক্টর জমির ধান। বাকি জমিগুলোর ১০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেখানে ফুল ফোটা পর্যায়ে ছিল, সেটাতে প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ ক্ষতি হয়।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় আর ধানের ফলন বৃদ্ধিতে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম এবং গড় ফলন বিশ্বমানের। কিন্তু দেশের কৃষিতে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে উচ্চ তাপমাত্রা বা ‘হিট শক’। দীর্ঘদিনের বৃষ্টিহীন উচ্চ তাপপ্রবাহ এই হিট শকের কারণ।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, অঙ্গজ বৃদ্ধি পর্যায়ে উচ্চ তাপমাত্রা ফলনে তেমন ক্ষতিকর প্রভাব না ফেললেও প্রজনন পর্যায়ে তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে ধানের ফলনের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ধানের পরিপক্ব হয়ে ওঠার পর্যায়ে উচ্চ তাপমাত্রা (৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি) দানা গঠন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে বিধায় অর্ধপুষ্ট দানার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, যা ধানের ফলন ও গুণমান কমে যায়।
ধানবিজ্ঞানীরা বলছেন, নতুন প্রজাতির ধান কৃষকদের জন্য সুখবর নিয়ে আসবে। আমরা যে চালের লাইন তৈরি করেছি, তা দিনের তাপমাত্রার ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত সহ্য করতে সক্ষম হবে। ধানের তাপ সহনশীলতা বৃদ্ধিতে আমাদের আরো বেশি কাজ করতে হবে। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (গবেষণা) ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান বলেন, ব্রি-ধান ২৮-এর সঙ্গে ক্রস করে নতুন এই ধান উদ্ভাবন করা হচ্ছে। এ কারণে এ ধানের ফলন ও তাপমাত্রা সহ্য করার ক্ষমতা বেশি থাকবে।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সাজ্জাদুর রহমান বলেন, নতুন জাত উদ্ভাবন করা হলে ৩৫ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভালো ফলন পাওয়া যাবে। তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রির বেশি হলেও ৫০ শতাংশ ধান রক্ষা করা যাবে। তবে উচ্চ তাপমাত্রায় যাতে ধানের ফলন না কমে, সে জন্য নানা ধরনের গবেষণা ও কৌশল নিয়ে কাজ চলছে।