মাজিদ আহমেদ
নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা না হওয়া সংস্কার কাজের অগ্রগতি অস্পষ্ট সবমিলিয়ে সরকার কঠোর সমালোচনায়.
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের নয় মাস শাসনামলের পরও আগামী নির্বাচন নিয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা ও নির্বাচন ঘিরে সংস্কার কার্যক্রমের আশানুব্যঞ্জক অগ্রগতি না হওয়ায় উদ্বেগ বাড়ছে বিএনপিতে। তারা বলছে, নির্বাচন নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে টালবাহানা করা হচ্ছে। উপদেষ্টারা একেকজন একেক কথা বলছেন। নির্বাচন ইস্যুতে গত ১৬ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল বৈঠকের পর ‘অসন্তাষ’ প্রকাশ করে কঠোর কর্মসূচিতে না যাওয়ার কথা বললেও সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করবে বলে দলটির একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। এরই অংশ হিসেবে দলটির শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন সভা-সমাবেশ থেকে সরকারের কড়া সমালোচনা করছেন এবং সংকট উত্তরণে দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছেন।
গত কয়েক দিনে দেখা গেছে, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপি নেতারা তাদের উদ্বেগ-উৎকন্ঠার কথা প্রকাশ করছেন। শনিবার রাজধানীর দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের চিন্তা এবং কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে জনগণ অন্ধকারে থাকায় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা বাড়ছে। মাত্র ১০ মাসের মাথায় সরকারের ভেতরে এবং বাইরে এক ধরনের অস্থিরতা দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। সরকার জনগণের ভাষা, আশা-আকাঙ্খা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তেই থাকবে।
শুধু তারেক রহমানই নয় দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য থেকে শুরু করে সকল প্রায় সকল শ্রেনীর নেতারাই সভা-সমাবেশ থেকে সরকারের কঠোর সমালোচনা করছেন। একইদিনে খুলনায় সমাবেশ থেকে প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘আপনি কি চান নির্বাচনের জন্য আপনার সঙ্গে আমাদের কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব সৃষ্টি হোক? এ দেশের জনগণ যমুনামুখী লংমার্চ করুক? হুঁশিয়ার করে দিতে চাই সম্মানের সঙ্গে বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করুন ডিসেম্বরের মধ্যে।
এর দুইদিন আগে কুমিল্লায় আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বর্তমান সরকারের হাতে নিরাপদ নয়। আগে ছিলাম কুকুরের মুখে, এখন পড়েছি বাঘের মুখে। সিন্দাবাদের বুড়োর মতো এই সরকার আমাদের ঘাড়ে চেপে বসেছে, নেমে যেতে চায় না। তাই আমাদের ঘাড় থেকে তাদের ঝাঁকি দিয়ে নামাতে হবে।
বিএনপির নেতৃবৃন্দ বলছেন, করিডর ইস্যু, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, নানা দাবি-দাওয়া সার্বিক পরিস্থিতি দেশ পর্যায়ক্রমে অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। উদ্বিগ্ন দলটির শঙ্কা, ঘটনাক্রম যেভাবে এগোচ্ছে, আগামীতে তা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এতে নির্বাচন নিয়ে যে জনআকাঙ্খা এবং নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রে উত্তরণের যে পথ, সেটি আরও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে পারে। সরকারের মেয়াদের নয় মাসেও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা না করাটাই একটা রহস্য।
তারা বলছেন, সংস্কারের দোহাই দিয়ে নির্বাচন প্রলম্বিত করতে চায়। জামায়াতে ইসলামীসহ আরও দু-একটি দলের ভূমিকাও অস্পষ্ট। এ অবস্থায় নির্বাচন আদৌ হবে কি না তা নিয়েও সন্দিহান অনেকে। সবাই আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রয়েছেন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়। আবার নির্বাচন নিয়ে দেশিবিদেশি ষড়যন্ত্রের গন্ধও পাওয়ার কথা বলছেন।
জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক মানববন্ধনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সরকারকে বলব, ডানে-বাঁয়ে সবদিকে তাকিয়ে যথাযথভাবে দেশ শাসন করুন, না হলে কেউ রক্ষা পাবেন না। লক্ষ্মীপুরে এক অনুষ্ঠানে দলটির যুগ্ম মহাসচিব শহীদউদ্দীন চৌধুরী এ্যানি বলেন, শাহবাগ ও যমুনায় আন্দোলন হচ্ছে, কোনো মিছিলে বা সমাবেশে তো পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল-লাঠিচার্জ করে না। তাহলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর হামলা-লাঠিচার্জ কেন করা হয়েছে? আবার এক উপদেষ্টার ওপর হামলা হয়েছে; সবকিছুই ষড়যন্ত্রের অংশ, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য।
বিএনপি মনে করে, অবনতিশীল ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে নির্বাচনই একমাত্র পথ। দলটির নেতারা বলছেন, সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করে সরকারের উচিত সংকট উত্তরণে দ্রুত সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দিয়ে দেশকে নির্বাচনমুখী করা। তবে সরকার নির্বাচন নিয়ে গড়িমসি করলে তাদের বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতে পারে। দলটি মনে করে, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব।
বিএনপির সমমনা দলের নেতারাও জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশিবিদেশি নানান ধরনের ষড়যন্ত্রে আশঙ্কার কথা বলছেন। বিশেষ করে যেসব রাজনৈতিক দল অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে ৫ থেকে ১০ শতাংশের বেশি ভোট পাবে না, তারাই মূলত নির্বাচন প্রলম্বিত করতে চায়।
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়কারী ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, যত দিন যাচ্ছে সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। মানুষের দাবিদাওয়া বাড়ছে। সংকটের একমাত্র সমাধান নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা। তিনি বলেন, এই সরকার তিনমাসের সরকার। করিডর দেওয়ার মত সিদ্ধান্ত এই সরকার নিতে পারে না। ‘আগামী জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হবে’ সরকারপ্রধানের এমন ঘোষণা মানুষ আর বিশ্বাস করছে না। সরকারের প্রতি মানুষ আস্থা হারাচ্ছে।