আফজাল হোসেন। ফাইল ছবি
নিজস্ব প্রতিবেদক:
বিসিএস নবম ব্যাচের কর ক্যাডারের কর্মকর্তা মো. আফজাল হোসেন। বর্তমানে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব। তিনি উড়ে এবং ঘুরে বেড়াতেই পছন্দ করেন। গত দুই মাসে তিনি আইভরি কোস্ট, যুক্তরাষ্ট্র ও সংযুক্ত আরব আমিরাতেই কাটিয়েছেন ২৮ দিন। গত ৮ আগস্ট পোস্টাল কংগ্রেসে যোগ দিতে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ আইভরি কোস্টে যান। ২৭ আগস্ট দেশে ফেরার এক দিন পরই ২৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক টেলিকম সপ্তাহে যোগ দিতে উড়াল দেন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডের উদ্দেশে। সেখান থেকে দেশে ফেরেন ১ সেপ্টেম্বর। এরপর তিনি দেশেই রাজশাহী ও মানিকগঞ্জে সরকারি সফরের নামে ঘুরে বেড়ান কয়েক দিন। রাজশাহীতে পায়ে ব্যথা পেলে তিনি নিজ বাসায় ছুটিও কাটান। সব মিলে গত দুই মাসে তিনি ৮-১০ দিন সশরীরে অফিস করেছেন বলে মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে। এরপর তিনি গত ১৩ অক্টোবর থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত ‘জি-ট্যাক্স গ্লোবাল এক্সিবিশন’-এ যোগ দিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই গেছেন। তার সঙ্গে রয়েছেন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কামরুজ্জামান, যুগ্মসচিব ও মন্ত্রীর একান্ত সচিব সেবাস্টিন রেমা এবং মো. আবদুল হান্নান। একই সফরে রয়েছেন সচিবের একান্ত সচিব (উপসচিব) শামসুল আলম ও আরেক উপসচিব মো. সাজ্জাদ হোসেন। এ ছাড়া সফরে সচিব আফজাল হোসেনের স্ত্রী ও অতিরিক্ত সচিব কামরুজ্জামানের স্ত্রীও রয়েছেন বলে জানা গেছে। তারা আগামী ২১ অক্টোবর অফিস করবেন বলে মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
সচিবের এমন ঘুরে বেড়ানো নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে মন্ত্রণালয়ের অন্য কর্মকর্তাদের মধ্যেও। গতকাল ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, সচিবসহ এ বিভাগের দুজন অতিরিক্ত সচিব, দুজন যুগ্মসচিব ও দুজন উপসচিব বর্তমানে বিদেশ রয়েছেন। এ ছাড়া একজন অতিরিক্ত সচিব গত ১১ অক্টোবর থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত পাঁচ দিন কানাডা সফর শেষে দেশে ফিরেছেন। ১ নভেম্বর একটি প্রকল্পের হয়ে ফ্রান্স ও ইন্দোনেশিয়া সফরে যাচ্ছেন যুগ্মসচিব রাশিদা ফেরদৌস। তিনি ৯ নভেম্বর দেশে ফিরবেন বলে জানা গেছে।
সরকারি কর্মকর্তাদের দীর্ঘ সময় বিদেশ থাকায় মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তাদের মতে, এভাবে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা দিনের পর দিন বিদেশে থাকলে জনগণকে কাক্সিক্ষত সেবা দেওয়া সম্ভব নয়। যারা এভাবে বিদেশ যান এবং যারা অনুমতি দেন উভয়কেই এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও বিশিষ্ট প্রশাসনবিষয়ক কলামিস্ট আলী ইমাম মজুমদার বলেন, সচিব হলেন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা। তিনি বিদেশ গেলে নিশ্চয় সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই যাচ্ছেন। দীর্ঘদিন কর্মকর্তারা নিজ দফতরে অনুপস্থিত থাকলে মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হবে- এটাই স্বাভাবিক। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা যেমন ঘন ঘন বিদেশ গিয়ে ঠিক কাজ করছেন না, তেমনি যারা এ বিদেশ ভ্রমণে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছেন তারাও সঠিক কাজ করছেন না। সংশ্লিষ্টদের এ ব্যাপারে আরও সতর্ক হওয়া উচিত।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সরকারি সফর ও নিজেদের দক্ষতা উন্নয়নের নামে বিদেশ যান কর্মকর্তারা। অনেকে প্রকল্পের টাকা আনতেও বিদেশ যান। কিন্তু এসব কর্মকর্তার অনেকে সরকারি স্বার্থের চেয়ে অপ্রয়োজনে ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আনন্দ ভ্রমণ করতে যান। মার্কেটে ঘুরে বাজার করে থাকেন। জুনিয়র কর্মকর্তার যাওয়ার প্রয়োজন হলেও অনেক সময় বড় কর্মকর্তারাই বিদেশ যান। সরকারি সফরে পরিবার-পরিজন নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। সরকারকে এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে।
জানা গেছে, ২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এরপর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলে ওই বছরের ২৫ মার্চ বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও সাধারণ ছুটি বা লকডাউন জারি করা হয়। এরপর গত বছরের শেষ দিকে করোনা সংক্রমণ কমলেও চলতি বছরের মার্চে আবারও তীব্র আকার ধারণ করে। এরপর আবারও লকডাউনের (বিধিনিষেধ) ঘোষণা আসে সরকারের পক্ষ থেকে। দেশের সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিমান যোগাযোগও বন্ধ রাখা হয়। বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয় গত ১১ আগস্ট। এর আগেই ইউনিভার্সেল পোস্টাল ইউনিয়নের (ইউপিইউ) আয়োজনে গত ৮ আগস্ট ‘২৭তম ইউনিভার্সেল পোস্টাল কংগ্রেস’ এ যোগ দিতে আইভরি কোস্টে যান ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব। ২৭ আগস্ট দেশে ফেরার এক দিন পরই ২৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক টেলিকম সপ্তাহে যোগ দিতে উড়াল দেন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডের উদ্দেশে। সেখানে তিনি স্ত্রী দেওয়ান নাসিমা সুলতানা এবং কন্যা শাবাব তাসনীম হোসেনকে নিজ খরচে নেন। তবে এবারের দুবাই ট্যুরে তিনি স্ত্রীকে সঙ্গে নিলেও কোনো জিও জারি করা হয়নি মন্ত্রণালয়ের। তবে অতিরিক্ত সচিব কামরুজ্জামানের স্ত্রী রেবেকা সুলতানা চৌধুরীর সফরের জিও জারি করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ করে মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তা মুখ খুলতে চাননি বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান, সচিব স্যার ১৯ অক্টোবর দেশে ফিরলেও অফিস করবেন ২১ অক্টোবর। স্যার বিদেশ ঘুরতেই ভালোবাসেন। যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় স্যারের স্ত্রী-কন্যার জিও জারি করে নিয়ে গেলেও এবার দুবাই ট্যুরে জিও জারি করা হয়নি। স্যারের স্ত্রী গেছেন কিনা জানি না। তবে ‘লেটার অব ইন্ট্রুডাকশন’ (এলওআই) জারি করা হয়েছে। এটার বলেই স্যার তার নিজ পরিবারের যে কোনো সদস্য সঙ্গে নিতে পারবেন। ওই কর্মকর্তা জানান, স্যার (সচিব) রাজশাহীতে ডাক ক্যাডারের নবীন কর্মকর্তাদের একটি প্রশিক্ষণে ক্লাস নিতে গিয়ে পায়ে ব্যথা পান। এরপর থেকে তিনি বাড়ি থেকেই অফিসের ফাইলে সই করেন। এরই মধ্যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে স্থানীয় বাঁধ নির্মাণসংক্রান্ত কাজে মানিকগঞ্জেও সরকারি সফরে যান। তবে সব মিলে গত দুই মাসে তিনি ৮-১০ দিন অফিস করেছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক সচিব প্রশাসন বিশেষজ্ঞ আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, একটি মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ ৮-১০ জন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বিদেশ থাকলে মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হবেই। দীর্ঘদিন কর্মকর্তারা বিদেশ থাকলে জনগণের কাক্সিক্ষত সেবা দেওয়াও সম্ভব নয়। মন্ত্রণালয়ে আরও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অন্য অতিরিক্ত সচিব মো. শাহাদাৎ হোসেন গত ১৫ অক্টোবর এক মাসের জন্য জার্মানিতে গেছেন। সেখানে তার কন্যার বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিসংক্রান্ত কাজ করবেন বলে জানা গেছে। ফলে বর্তমানে মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ শাখাগুলোতে কোনো কাজই হচ্ছে না। সচিবের সঙ্গে বিদেশে রয়েছেন মন্ত্রণালয়ের আরেক অতিরিক্ত সচিব কামরুজ্জামান, যুগ্মসচিব ও মন্ত্রীর একান্ত সচিব সেবাস্টিন রেমা ও মো. আবদুল হান্নান। একই সফরে রয়েছেন সচিবের একান্ত সচিব (উপসচিব) শামসুল আলম ও আরেক উপসচিব মো. সাজ্জাদ হোসেন। তারা আগামী ২১ অক্টোবর অফিস করতে পারেন বলে মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
বিএসডি / আইপি