আন্তর্জাতিক ডেস্ক,
২০০১ সালের পর এই প্রথম একটি দিন দেখলেন আফগানিস্তানের নাগরিকরা, যেদিনে দেশটিতে একজনও আমেরিকান সৈন্য নেই। দুই দশকের যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে নিজ নাগরিক এবং ঝুঁকিতে থাকা হাজার হাজার আফগানকে সরিয়ে নেওয়ার পর মঙ্গলবার রাতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র বাহিনী আফগানিস্তান ত্যাগ করেছে।
আফগানিস্তানের সশস্ত্র কট্টর ইসলামপন্থী গোষ্ঠী তালেবান দেশের ক্ষমতা দখলে নেওয়ায় রাজধানী কাবুল থেকে গত দুই সপ্তাহে এক লাখ ১৪ হাজারের বেশি মানুষকে সরিয়ে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা। কিন্তু আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক উপস্থিতির অবসান বাইডেন এবং তার প্রশাসনের জন্য নতুন কিছু প্রশ্ন তুলেছে…
কাবুলে রেখে যাওয়া আমেরিকান এবং ঝুঁকিপূর্ণ আফগানদের ভাগ্যে কী ঘটবে?
গত ১৪ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া উদ্ধার অভিযানে যুক্তরাষ্ট্র কাবুল থেকে সাড়ে ৫ হাজারের বেশি মার্কিনিকে সরিয়ে নিয়েছে। তবে অল্পসংখ্যক আমেরিকান নাগরিক আফগানিস্তানে থেকে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই সেখানে পরিবারের সঙ্গে থাকতে চেয়েছেন।
জো বাইডেনের প্রশাসন বলেছে, মার্কিন সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন হওয়ার পর তালেবান আমেরিকান এবং অন্যান্যদের আফগানিস্তান নিরাপদে ত্যাগের সুযোগ অব্যাহত রাখবে বলে তারা প্রত্যাশা করছে। কিন্তু দেশটিতে যদি বিমানবন্দর সচল না থাকে তাহলে ওই নাগরিকরা কীভাবে আফগানিস্তান ত্যাগ করবেন সেটি নিয়ে উদ্বেগ আছে।
আফগানিস্তানে এখনও লাখ লাখ মানুষ তালেবানের ঝুঁকিতে আছেন। তাদের মধ্য অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে অনুবাদক হিসেবে কাজ করেছেন, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মীও আছেন; যাদের রেখে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের ভাগ্যে কী ঘটবে সেটি পরিষ্কার নয়। তাদের বিরুদ্ধে তালেবান প্রতিশোধ নিতে পারে বলে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
এদিকে, তালেবান সব বিদেশি নাগরিক এবং যথাযথ ভ্রমণের নথিধারী আফগানদের দেশত্যাগের অনুমতি দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে বলে রোববার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য কয়েকটি দেশের এক যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।
কাবুল বিমানবন্দরে কী ঘটবে?
গত দুই সপ্তাহ ধরে ছয় হাজারের বেশি সৈন্য মোতায়েনের মাধ্যমে কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা এবং কর্মকাণ্ড সচল রাখার দায়িত্ব পালন করেছে মার্কিন সামরিক বাহিনী। এই বিমানবন্দরের বেসামরিক ফ্লাইট পরিচালনা অব্যাহত রাখতে সহায়তার জন্য কাতার এবং তুরস্কের মতো কিছু দেশের সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছে তালেবান। আফগানিস্তান ত্যাগের একমাত্র পথ কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
রোববার তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু বলেছেন, বেসামরিক ফ্লাইট পরিচালনার জন্য বিমানবন্দরটি পুনরায় খুলে দেওয়ার আগে মেরামত করতে হবে।
পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর মিশনের অংশ হিসেবে গত ছয় বছর ধরে কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় তুরস্কের সৈন্যরাও নিয়োজিত ছিলেন। বিদেশি সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে কাবুল বিমানবন্দর সচল রাখাটা শুধুমাত্র আফগানিস্তানের জন্যই নয়, বরং মানবিক ত্রাণ সহায়তা সরবরাহ এবং ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্র-তালেবানের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কেমন হবে?
ওয়াশিংটন বলেছে, তারা কোনও কূটনীতিকই আফগানিস্তানে রাখবে না এবং তালেবানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কেমন হবে, সেটি তাদের কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভর করবে। কিন্তু দেশটিতে যাতে মানবিক এবং অর্থনৈতিক সংকট ছড়িয়ে না পড়ে সেটি নিশ্চিত করার জন্য বাইডেন প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে।
জাতিসংঘ বলেছে, আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ এক কোটি ৮০ লাখের বেশি মানুষের মানবিক সহায়তা দরকার। এছাড়া গত চার বছরে দ্বিতীয়বারের মতো খরার মুখোমুখি হওয়া আফগানিস্তানের ৫ বছরের নিচের অর্ধেক শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে।
ব্রিটেনসহ কিছু দেশ বলেছে, তালেবানকে আফগানিস্তানের সরকার হিসেবে কোনও দেশেরই স্বীকৃতি দেওয়া উচিত হবে না।
জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট কী ধরনের হুমকি তৈরি করছে?
যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্র ইসলামিক স্টেট জঙ্গিদের জন্য হুমকি হতে পারে। কীভাবে ওয়াশিংটন এবং তালেবান নিজেদের মধ্যে সমন্বয়, এমনকি এই গোষ্ঠীকে মোকাবিলায় তথ্য আদান-প্রদান করবে সে বিষয়ে প্রশ্ন আছে।
আফগানিস্তানে ইসলামিক স্টেটের স্থানীয় অনুসারী ইসলামিক স্টেট অফ খোরাসানের (আইএসআইএস-কে) জন্ম ২০১৪ সালের শেষের দিকে দেশটির খোরাসান প্রদেশে। চরম নিষ্ঠুরতা চালানোর জন্য এই গোষ্ঠীর কুখ্যাতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। গত ১৩ আগস্ট কাবুলের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে ১৩ মার্কিন সৈন্যসহ ১৭০ জনকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট খোরাসান।
তারপর এই গোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কমপক্ষে দু’বার ড্রোন হামলা চালিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ওই হামলার প্রতিশোধ নেওয়া অব্যাহত রাখবে তার প্রশাসন।
তালেবানের শপথপ্রাপ্ত শত্রু হিসেবে মনে করা হয় আইএসআইএস-কে’কে। কিন্তু মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বিশ্বাস, খোরাসানের আঞ্চলিক এই জঙ্গিগোষ্ঠী চলতি মাসের অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়েছে; যে কারণে আফগানিস্তানে পশ্চিমা বিশ্ব-সমর্থিত সরকারের পতন ঘটেছে এবং তালেবানের অবস্থান হয়েছে। একই সঙ্গে তালেবানে নতুন সদস্য নিয়োগও বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিএসডি/এএ