বর্তমান সময় ডেস্ক:
মহামারিতে বিশ্বে এখনও দাপট দেখাচ্ছে করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। এরই মধ্যে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চল এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শনাক্ত হয়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ‘ওমিক্রন’। ভবিষ্যতে কোন ভ্যারিয়েন্ট দাপট দেখাবে তা নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন বিজ্ঞানীরা। দক্ষিণ আফ্রিকা ও যুক্তরাজ্য থেকে কিছু তথ্যের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীদের ধারণা, দাপুটে হয়ে ওঠার এই লড়াইয়ে বিজয়ী হতে পারে ওমিক্রন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের নেতৃত্বে একটি গবেষণা কাজের জন্য করোনাভাইরাসের ভ্যারিয়েন্টগুলো পর্যবেক্ষণ করছেন ড. জ্যাকব লেমিয়াক্স। তিনি বলেন, এখনও অল্প কয়েক দিন হয়েছে, কিন্তু ক্রমাগত যেসব তথ্য আসছে তাতে দেখা যাচ্ছে ওমিক্রন সম্ভবত ডেল্টাকে পেছনে ফেলে দেবে, সব জায়গাতে না হলেও বহু জায়গায়।
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার অন্যতম এক উদ্ভাবক সতর্ক করে বলেছেন, বর্তমান করোনা সংকটের চেয়ে ভবিষ্যতের মহামারি আরও প্রাণঘাতী হতে পারে। বিশ্বের ৪০টির বেশি দেশে ওমিক্রনে সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। কারণ করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের বিরুদ্ধে বিদ্যমান টিকা কম কার্যকর হতে পারে। কোনো ভাইরাস দ্বারা মানুষের জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে পড়ার এটাই শেষ ঘটনা হবে না। সত্য হলো, পরের মহামারিটি আরও খারাপ হতে পারে। সেটি আরও সংক্রামক বা আরও প্রাণঘাতী বা উভয়ই হতে পারে।
ইতোমধ্যে বিশ্বের ৫৭টি দেশে ছড়িয়েছে ওমিক্রন। বিশ্বজুড়েই নানা শঙ্কার কারণে সীমান্ত নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বিভিন্ন দেশ। তবে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণের জন্য ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা অকার্যকর এবং এটি ওমিক্রন সংক্রমণ থামাবে না বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তবে ডব্লিউএইচও বলছে, টিকা নেয়া এবং মাস্ক পরা কোভিডের এই স্ট্রেইনটির অগ্রযাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে সংক্রমণের হার এখনও দুই শতাংশের নিচে এবং ১ শতাংশের সামান্য উপরে। কিন্তু এতে করে আমাদের কোনোভাবেই আত্মতুষ্টিতে ভুগার কোনো কারণ নেই। কারণ, ঘরের দরজাতেই ওমিক্রন কড়া নাড়ছে। কাজেই এই মুহূর্তে আমাদের সর্বোচ্চ সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে, জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
বাংলাদেশের পাশের দেশ ভারতেও ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে, শনাক্ত হয়েছে শ্রীলংকা ও নেপালেও। আর এতে করে ওমিক্রন থেকে শঙ্কা মুক্ত নয় বাংলাদেশ। যার কারণে ওমিক্রন ঠেকাতে ১৫টি নির্দেশনা দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর, সুপারিশ দিয়েছে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটিও। কিন্তু রাজধানীর কোথাও স্বাস্থ্য অধিদফতরের সেই নির্দেশনা কিংবা জাতীয় কমিটির সুপারিশের বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের ১৫ নির্দেশনার মধ্যে অন্যতম হলোÑ সব ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অন্যান্য জনসমাগম নিরুৎসাহিত করা, প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যাওয়া প্রত্যেক ব্যক্তির সর্বদা সঠিকভাবে নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরাসহ সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করা, রেস্তোরাঁতে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা ধারণক্ষমতার অর্ধেক বা তার কম রাখা, সকল প্রকার জনসমাবেশ, পর্যটন স্থান, বিনোদন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার, সিনেমা হল বা থিয়েটার হল ও সামাজিক অনুষ্ঠানে (বিয়ে, বৌভাত, জন্মদিন, পিকনিক পার্টি ইত্যাদি) ধারণক্ষমতার অর্ধেক বা তার কম সংখ্যক লোকের অংশগ্রহণ, মসজিদসহ সকল উপাসনালয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করা এবং গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা।
দেশে ওমিক্রন মোকাবেলায় সব প্রস্তুতি নিয়ে সাংবাদিকদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, দেশে সাউথ আফ্রিকা এবং আফ্রিকা থেকে যারাই আসবেন তাদের ৪৮ ঘণ্টা আগে পরীক্ষা করে আসতে হবে এবং ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। অন্যান্য যেসব দেশে ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে সেখান থেকে আসার ৪৮ ঘণ্টা আগে পরীক্ষা করে আসতে হবে। সীমান্তে পরীক্ষা ও কোয়ারেন্টিনের বিষয়টি জোরদার করেছি। ঢাকায়ও আমরা অনেকগুলো কোয়ারেন্টিন সেন্টার করেছি। বিশেষ করে হাসপাতাল, যেগুলো আগেও আমরা ব্যবহার করেছি, সেখানে কোয়ারেন্টিন সেন্টার করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যারা বাইরে থেকে আসবেন তারা সেখানে নিজ খরচে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিন করতে পারবেন। এয়ারপোর্টের স্ক্রিনিং ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে, ল্যাবটি অনেক বড় করা হয়েছে। আগে এটি ২ হাজার স্কয়ার ফিটের ছিল, এখন ৩০ হাজার স্কয়ার ফিটের করা হয়েছে।
গত ১ সপ্তাহে রাজধানীতে দেখা যায়, পাড়া কিংবা মহল্লা, হাসপাতাল, গণপরিবহন, বিপণিবিতান কোথাও স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। মুখে মাস্ক ব্যবহার না করে হরহামেশা ঘোরাঘুরি করছে মানুষ। সুযোগ পেলেই চায়ের দোকানে আগের মতো জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে নেই কোনো সচেতনতা। বাইরের দেশগুলোতে করোনার নতুন ধরন শনাক্ত হলেও দেশে তরুণ কিংবা বয়স্ক, শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত কেউই সরকারের আরোপিত বিধিনিষেধ ও স্বাস্থ্যবিধি মানতে চাইছেন না। বাসে যাত্রীরা দু-একজন ছাড়া চালক-হেলপারসহ অধিকাংশ কারও মুখেই মাস্ক নেই। অনেকের মাস্ক পরায় অনীহা তৈরি হয়েছে।
পরিবহনে আসন সংখ্যার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে। মাস্ক মুখে দিলে আনেকের হাঁসফাঁস লাগে। কেউ আবার গলায় ঝুলিয়ে, আবার কেউ নাকের নিচে মাস্ক রেখে ঘুরছেন। কেউ পকেটে রেখে দিয়েছেন। অনেকে মুখে মাস্ক পরাই ছেড়ে দিয়েছেন। বেশির ভাগ লোকজনেরই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে আগ্রহ দেখা যায়নি। স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে লোকজন চরম উদাসীন। করোনার নতুন ধরন শনাক্তের ব্যাপারেও অনেকের অজানা। হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের নেই কোনো স্বাস্থ্যবিধি ও সচেতনতা। একসঙ্গে গাদাগাদি করে হাসপাতালে প্রবেশ করছেন। রাত হলে হাসপাতালের মেঝেতে পাশাপাশি ঘুমাচ্ছেন। চায়ের দোকান ও শপিংমলগুলোর চিত্র আরও ভয়াবহ। করোনার শুরু থেকে সব জায়গায় মুখে মাস্ক ব্যবহার এবং হাত ধোয়ার জন্য পর্যাপ্ত সাবান-পানি ও জীবাণুনাশকের ব্যবস্থা রাখার নির্দেশনা দিয়েছিল সরকার। যাত্রা শুরু ও শেষে যানবাহন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা ও জীবাণুনাশক দিয়ে জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা রাখার কথাও বলা হয়েছিল। বিভিন্ন হাসপাতাল ও শপিংমলের প্রবেশ মুখে জীবানণুনাশক টানেল বসালেও এখন তা নেই। দু-একটা থাকলেও ব্যবহার অযোগ্য।
এ বিষয়ে জাতীয় পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, আমরা বললামÑ জনসমাগম সীমিত করতে হবে। অথচ কোথাও সমাবেশ বাদ যাচ্ছে না, সরকারিভাবেই বিভিন্ন সমাবেশ হচ্ছে। কোর্টে আইনজীবীরা ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের সব মাস্ক খোলা। সচেতন সমাজ বলতে আমরা যা মনে করি, সচেতন সমাজের অংশ যারাÑ তারাই সচেতন নন। এমন অবস্থায় সাধারণ মানুষকে আমরা কিইবা বলতে পারি।
এদিকে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক নাজমুল বলেন, সংক্রমণের হার এখনও বাংলাদেশে দুই শতাংশের নিচে ও ১ শতাংশের সামান্য উপরে। কিন্তু এতে করে আমাদের কোনওভাবেই আত্মতুষ্টিতে ভুগবার কোনো কারণ নেই। কারণ, ঘরের দরজাতেই ওমিক্রন কড়া নাড়ছে। কাজেই এই মুহূর্তে আমাদের সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেই হবে, করোনা প্রতিরোধে এটিই হচ্ছে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। টিকা নেয়ার পাশাপাশি সঠিকভাবে নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরতে হবে, নিরাপদ দূরত্ব মেনে যদি চলা হয় তাহলে এই অতিমারি নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়ে যাবে। আমরা মনে করি, সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। আতঙ্কিত না হয়ে সকলকে সচেতন হয়ে ব্যক্তিগত এবং সামাজিকভাবে শিষ্টাচার মেনে চলতে হবে। ‘মাস্ক আমার, সুরক্ষা সবার’-এই কথা যেন আমরা কোনওভাবেই ভুলে না যাই।
বিএসডি/এসএফ