বর্তমান সময় ডেস্ক:
জন্ম নিলে মরতে হবে, এ কথাটিই চূড়ান্ত। একমাত্র স্রষ্টাই চিরঞ্জীব ও চিরন্তন। দুনিয়া নামক ক্ষণস্থায়ী মুসাফিরখানায় আমরা বসবাস করছি এবং প্রতিমুহূর্তে এগিয়ে চলছি চিরস্থায়ী আপন ঠিকানায়, কেউ আগে কেউ বা পরে। কার সিরিয়াল কখন হবে কেউ আমরা জানি না। যদিও পৃথিবীতে আসার সিরিয়াল সুনির্দিষ্ট। প্রথমে দাদা তারপর বাবা তারপর সন্তান তারপর নাতি। কিন্তু যাওয়ার বেলায় এ সিরিয়াল ভেঙে যায়।
পৃথিবীতে এসেছ তুমি খালি হাতে, যাওয়ার বেলায় তুমি যেও পূর্ণ হাতে। কেননা দুনিয়া আখিরাতের সুখ-শান্তি ইজ্জত সম্মান অর্জন করার ক্ষেত্রবিশেষ। প্রথম যেদিন তুমি এসেছিলে ভবে, কেঁদেছিলে তুমি একা হেসেছিল সবে। এমন জীবন তুমি কর হে গঠন, মরিলে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন। মৃত্যু, কাফন-দাফন, কবর, হাশর মিজান, পুলসিরাত ও আখিরাতের কথা, চিন্তাভাবনা, মানুষের জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দিতে পারে। নেক আমলের প্রতি হৃদয় উদ্দীপ্ত হয়। তাই আখিরাতের স্মরণের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো কবর জিয়ারত।
গভীরভাবে নীরবে নিজের মৃত্যুর পর পরিণতির কথা চিন্তা করা। সাপ-বিচ্ছু, নিকষ কালো অন্ধকার, ভয়াবহ নীরব নির্জন, প্রিয়জন আপনজনকে ছেড়ে ওই অন্ধকার কবরে কীভাবে হাজার হাজার বছর থাকব ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। কবরের পাশ দিয়ে গেলেও মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়। নিজের জীবনের কৃত অপরাধে অনুতপ্ত হয়। গুনাহ ও অন্যায় থেকে তওবা করার মানসিকতা তৈরি হয়। ফলে নিজের জীবন পরিবর্তন করে জাহান্নাম থেকে নিজেকে মুক্ত করে জান্নাতি হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যায়। তাই নিজের পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন ও বিশ্বের মুসলিমদের কবর জিয়ারত করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
অন্যদিকে কবরবাসীরা বড় অসহায়, একটু নেকির আশায়, শাস্তি থেকে একটু নিস্তার পাওয়ার আশায় দুনিয়াবাসী আপনজনের পথের দিকে চেয়ে থেকে আফসোস আক্ষেপ করতে থাকে। অথচ আমাদের সময়ই হয় না বা আমরা অনেকেই কবর জিয়ারত করতেও পারি না। কবর জিয়ারতের নিয়মকানুন ও দোয়া সম্পর্কে কোনো জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাই আমাদের নেই। দুনিয়ার ব্যস্ততায় এত বেশি আমাদের গ্রাস করে ফেলেছে যে একমাত্র মৃত্যুই আমাদের তার থেকে সরিয়ে আনতে পারে। ফলে আকস্মিক মৃত্যু তাকেও অসহায় মিসকিনের মতো সবকিছু থেকে ছিন্নভিন্ন করে বিধ্বস্ত অবস্থায় ছিনিয়ে নিয়ে যায়। একটু সময় নিয়ে নিজেকে গুছিয়ে তোলার সুযোগটুকুও তার থাকে না।
প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আমি তোমাদের কবর জিয়ারতে নিষেধ করেছিলাম। এখন থেকে কবর জিয়ারত কর কারণ তা দুনিয়াবিমুখতা এনে দেয় এবং আখিরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।’ (ইবনে মাজাহ) প্রিয় নবী শবেবরতের বরকতময় রজনীতে মুসলমানদের কবরস্থানে জিয়ারত করেছেন। তিনি তাঁর উম্মতের জন্য দোয়া করেছেন।
কবর জিয়ারতের শুরুতে তাদের প্রতি সালাম ও দোয়া করা : হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) মদিনা কবরবাসীদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এভাবে সালাম ও দোয়া পাঠ করেন- আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর ইয়াগফিরুল্লাহু লানা ওয়ালাকুম আনতুম সালাফনা ওয়া নাহনু বিলআসার। অর্থাৎ হে কবরবাসীগণ! তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আল্লাহ আমাদের ও তোমাদের ক্ষমা করুন। তোমরা আমাদের আগে কবরে গিয়েছ এবং আমরা পরে আসছি। (তিরমিজি)
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার রসুল (সা.) একটি কবর জিয়ারতে গিয়ে বলেন, আসসালামু আলাইকুম দারাক্বাওমিম মুমিনিন ওয়া ইন্না ইনশাআল্লাহু বিকুম লাহিকুন। অর্থাৎ মুমিন ঘরবাসীর ওপর শান্তি বর্ষিত হোক, ইনশা আল্লাহ আমরা আপনাদের সঙ্গে মিলিত হব। (মুসলিম)
সমস্যা না হলে কবরস্থানে জুতা খুলে প্রবেশ করা। সব রকমের গল্পগুজব ও হাসি-তামাশা বর্জন করা। ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় অত্যন্ত আদবের সঙ্গে অবস্থান করা। কবরের কাছে যাওয়ার পর সর্বপ্রথম জিয়ারতের উদ্দেশে কবরবাসীকে সালাম দেওয়া ও দোয়া পড়া। এরপর দরুদ ও বিভিন্ন সুরা পড়তে থাকা, বিশেষ করে সুরা ফাতিহা একবার, আয়াতুল কুরসি একবার, সুরা ইখলাস তিনবার পড়া, যা এক খতম কোরআন পড়ার নেকি তার আমলনামায় সংযুক্ত হবে, সুরা কাফিরুন, সুরা ফালাক, সুরা নাস, সুরা তাকাসুর সম্ভব হলে সুরা ইয়াসিন তিলাওয়াত করা। এরপর নিজের মা-বাবা, আত্মীয়স্বজনসহ সারা বিশ্বের মুসলিম কবরবাসীর মাগফিরাতের জন্য মহান রব্বুল আলামিনের দরবারে অতি বিনয়ের সঙ্গে মুনাজাত করা।
দোয়া পড়ার সময় কবরের দিকে তাকিয়ে বলা যাবে। কিন্তু মুনাজাত করার সময় কবরের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে কিবলামুখী হয়ে মহান রব্বুল আলামিনের দিকে ফিরে দুই হাত তুলে মুনাজাত করা। এ ক্ষেত্রে হাত না তুলেও মুনাজাত ও মাগফিরাত কামনা করা যাবে। সম্ভব হলে আপনজনের কবরের পাশে গিয়েই জিয়ারত করা, কেননা এতে তাদের আত্মা তাদের উপস্থিতি অনুভব করে। ও আনন্দিত হয়। আর সম্ভব না হলে যে কোনো স্থান থেকে তাদের জন্য শুধু দোয়া করে সওয়াব রেসানি করা।
প্রতি নামাজের পর ও নেক আমলের পর তাদের জন্য দোয়া করা। কেননা আমি যদি আজকে গুরুত্ব দিয়ে তাদের জন্য দোয়া করি তাহলে আমি যখন কাল কবরে যাব, আমার জন্যও অন্যরা অতি গুরুত্ব দিয়ে দোয়া করবে। শুধু কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে দূরদূরান্ত সফর না করা। তবে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রওজা জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদিনা মুনাওয়ারা সফর করা মুস্তাহাব। নবী, সাহাবি, অলি, আবদাল পীর-বুজুর্গদের কবর একই নিয়মে জিয়ারত করা। তবে তাদের কাছে কোনো জিনিস প্রার্থনা, কবরে কোনো কিছুর মান্নত ও দানসদকা করা কবিরা গুনাহ এবং কবরে সিজদা করা শিরক ও হারাম।
লেখক : ইমাম ও খতিব, কাওলারবাজার জামে মসজিদ, দক্ষিণখান, ঢাকা।
বিএসডি/ এলএল