ফিচার ডেস্ক-
রজনীকান্ত সেন ছিলেন বাঙালি কবি, গীতিকার ও সঙ্গীতশিল্পী। বাংলা সঙ্গীত জগতের অন্যতম দিকপাল। ‘কান্তকবি’ নামে খ্যাত ছিলেন তিনি। ১৮৬৫ সালের ২৬ জুলাই পাবনা জেলার ভাঙ্গাবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রজনীকান্ত। বাবা গুরুপ্রসাদ সেন ছিলেন একজন সঙ্গীতজ্ঞ ব্যক্তিত্ব। মা মনমোহিনী দেবীও ছিলেন সঙ্গীতানুরাগী। মা-বাবার অনুপ্রেরণায় মাত্র পনেরো বছর বয়সে কালীসঙ্গীত রচনা করে কবিত্বশক্তির পরিচয় দেন তিনি।
‘পঞ্চকবি’দের একজন রজনীকান্ত সেন। পঞ্চকবির অন্যরা হলেন- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুল প্রসাদ সেন। এছাড়া মহানায়িকা সুচিত্রা সেন তাঁর নাতনি। তবে সবকিছু ছাড়িয়ে রজনীকান্ত স্বমহিমাতেই চির ভাস্বর, বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতের আকাশের অন্যতম নক্ষত্র।
রাজশাহীতে অক্ষয়কুমার মৈত্রের বাড়িতে তিনি স্বরচিত গান পরিবেশন করতেন। সেখানকার ‘উৎসাহ’ নামক মাসিক পত্রিকায় রজনীকান্তের রচনা প্রকাশিত হতো। তিনি কবিতাও রচনা করতেন। তার কবিতা ও গানের বিষয়বস্তু ছিল প্রধানত ভক্তি ও দেশপ্রেম।
রজনীকান্ত ছেলেবেলায় বেশ ডানপিটে স্বভাবের ছিলেন। সারাদিনের দুরন্তপনা শেষে পড়াশুনার ফুরসতই মিলত না তাঁর। তবে অসম্ভব মেধার কারণে বরাবরই পরীক্ষায় ভালো ফল করতেন। এ ব্যাপারে নিজের ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন- ‘আমি কখনও বইপ্রেমী ছিলাম না। অত্যন্ত কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্যে ঈশ্বরের কাছে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই।’
কুচবিহার জেনকিন্স স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, রাজশাহী কলেজ থেকে এফএ এবং কলকাতা সিটি কলেজ থেকে বিএ ও বিএল ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। কর্মজীবনে রাজশাহী কোর্টে ওকালতি শুরু করেন। কিছুদিন তিনি নাটোর ও নওগাঁয় অস্থায়ী মুন্সেফও ছিলেন।
শারীরিক কসরৎ ও খেলাধূলায়ও বেশ আগ্রহী ছিলেন রজনী। খেলাধূলায় অতি উৎসাহের কারণে নিজ গ্রামে তিনি বেশ সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ছিলেন। সর্ববিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন, বিশেষ করে গান-বাজনা, খেলাধূলা, অভিনয়-কলা প্রভৃতি বিষয়ে পারঙ্গমতাই এর মূল কারণ। গ্রামের নিরক্ষর মহিলাদের মাঝে শিক্ষা প্রসারের জন্যেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
রজনীকান্ত রবীন্দ্রনাথের চার বছরের ছোট। অর্থাৎ তিনি রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়েরও সমসাময়িক কবি ছিলেন তিনি। ছোটবেলায় পড়া ‘স্বাধীনতার সুখ’ নামের কবিতার রচয়িতা রজনীকান্তের বহুলপাঠ্য কবিতার দুটি লাইন-
‘বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই- কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই?’
‘আশালতা’ নামের মাসিক একটি পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতে প্রকাশিত হয় রজনীকান্ত সেনের কবিতা। গান রচনায় অস্বাভাবিক দ্রুত গতিসম্পন্ন ছিলেন রজনীকান্ত। কলেজের কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন হলে ডাক পড়ত রজনীকান্তের। তিনি অনুষ্ঠান চলাকালীনই গান রচনা ও তাতে সুর সংযোজন করে তা গেয়ে আসর জমাতেন। তাঁর বিখ্যাত সব গানের বেশির ভাগই খুবই অল্প সময়ের মধ্যে রচিত।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে স্বদেশী আন্দোলনে বিলাতি সব পণ্য বয়কট করে দেশীয় পণ্য ব্যবহার করার প্রতি যে দুর্বার আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে ওঠে, সে আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের মতো রজনীকান্তও সমর্থন দেন। এ সময়ে রজনীকান্ত রচনা করেন-
‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই; দীন দুখিনি মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই।’
তাঁর এই গানটি গণ-আন্দোলনে প্রবল প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের জোয়ার সৃষ্ট করে। এর মাধ্যমেই তিনি খ্যাতি লাভ করেন এবং ‘কান্তকবি’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখার দারুণ ভক্ত ছিলেন রজনীকান্ত। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় নাটোর সফরে এলে তিনি পরম আগ্রহে তাঁর সাথে দেখা করেন। একসময় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সমপর্যায়ভুক্ত লেখা লিখতে শুরু করেন তিনি।
নীতিকবিতা রচনাতেও তাঁর জুড়ি ছিল না। জীবনের শেষ দিকে এসে অভিজ্ঞতার সমৃদ্ধ সঞ্চয়ে তিনি লিখে রেখে গেছেন নীত-আদর্শ সম্বলিত এই মহান নীতি কবিতাগুলো। বহুল পরিচিত দুয়েকটি এখানে উদ্ধৃতি হলো-
‘শৈশবে সদুপদেশ যাহার না রোচে, জীবনে তাহার কভু মূর্খতা না ঘোচে।’
‘নদী কভু নাহি করে নিজ জলপান
তরুগণ নাহি খায় নিজ নিজ ফল,
গাভী কভু নাহি করে নিজ দুগ্ধ পান,
কাষ্ঠ, দগ্ধ হয়ে, করে পরে অন্নদান।’
তবে রজনীকান্ত সঙ্গীতের জগতে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাঁর ঈশ্বর-ভক্তিমূলক গানগুলোর জন্যেই। ঈশ্বরের প্রতি তার অগাধ প্রেম, বিশ্বাস ও আস্থা তাঁর গানগুলোতে প্রতিভাত হয়ে বাংলা গানকে গভীর দর্শন চিন্তায় স্বাতন্ত্র্য দান করেছে। জীবনের সমস্ত আনন্দগুলোতে তিনি ঈশ্বরকে স্মরণ করেছেন। গভীর সংকটে যখন তিনি নিপতিত হয়েছেন, একে ঈশ্বরপ্রদত্ত আশীষ হিসেবেই মেনে নিয়েছেন। ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করবার উদ্দেশ্যে বিনয়ের সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে বারবারই নিজেকে দীন-হীনভাবে উপস্থাপন করেছেন রজনীকান্ত। তাই, তাঁর রচিত ভক্তিমূলক নানা গান প্রার্থনারূপে উপাসনালয়গুলোতে আজও গীত হয়।
মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন রজনীকান্ত। ছোটবেলাতেই তাঁর বড় ভাই ও বড় বোনের অকাল প্রয়াণ ঘটে। ছোট ভাই জননীকান্তও জলাতংক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এই সকল মৃত্যু তাঁকে গভীর জীবনবোধে উজ্জীবিত করতে ভূমিকা রাখে।
ব্যক্তিগত জীবনে রজনীকান্ত সেনের সাথে হিরন্ময়ী দেবীর বিয়ে হয়। তাদের সংসারে চার পুত্র ও দুই কন্যা। প্রিয়জনের মৃত্যুতে রজনীকান্ত গভীর ব্যথায় আহত হন, কিন্তু হতাশ হন না। বরং ঈশ্বরের উপর অগাধ বিশ্বাসে রচনা করেন—
‘তোমারি দেওয়া প্রাণে তোমারি দেওয়া দুখ,
তোমারি দেওয়া বুকে, তোমারি অনুভব৷
তোমারি দুনয়নে তোমারি শোক-বারি,
তোমারি ব্যাকুলতা তোমারি হা হা রব৷’
কন্যা শতদল বাসিনীর মৃত্যুতেও তাঁর আক্ষেপ জাগে না, জাগে না এতটুকু অভিমান। ঈশ্বরের প্রতি প্রশস্তি জ্ঞাপন করে লিখেন বিখ্যাত সেই গান-
‘আমি অকৃতি অধম বলেও তো কিছু
কম করে মোরে দাওনি;
যা দিয়েছ, তারি অযোগ্য ভাবিয়া
কেড়েও তা কিছু নাওনি।’
পরম বিনয়ের গুণে নিজের সমস্ত আরাধনা-উপাসনাকে তিনি সর্বদাই অপ্রতুল মনে করতেন রজনীকান্ত। তাই তার পরম প্রার্থনার প্রকাশ-
‘তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে, মলিন মর্ম মুছায়ে; তব পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক, মোর মোহ কালিমা ঘুচায়ে।’
জীবদ্দশায় বাণী, কল্যাণী এবং অমৃত- নামে তিনটি বই প্রকাশিত হয় তাঁর। মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় আরও পাঁচটি গ্রন্থ- অভয়া, আনন্দময়ী, বিশ্রাম, সদ্ভাবকুসুম ও শেষদান। এসব গ্রন্থে প্রকাশিত তাঁর গানগুলোকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়- দেশাত্মবোধক, ভক্তিমূলক, প্রীতিমূলক ও হাস্যরসাত্মক গান। কন্যা শান্তিবালা দেবীর দেয়া তথ্যানুসারে তাঁর মোট গানের সংখ্যা ২৯০টি। তবে অসংখ্য গান হারিয়ে গেছে বলেই জানা যায়।
ক্ষণজন্মা এই অমর সঙ্গীতকার ও লেখক ব্যক্তিত্বকে সম্মান জানিয়ে বাংলাদেশের প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক আসাদ চৌধুরী ১৯৮৯ সালে ‘রজনীকান্ত সেন’ শিরোনামে একটি জীবনীগ্রন্থ রচনা করেন।
রজনীকান্ত ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তবে এতো বড় অভিঘাতেও সামান্য বিচলিত হতেন না। পরম প্রিয় ঈশ্বরের কাছে জানালেন সুস্থতার আবেদন। কিন্তু সে আবেদন গ্রাহ্য না হলেও এতটুকু খেদ নেই বিধাতার প্রতি। তাঁর বরং মনে হলো, এসব দুঃখ-বেদনার মধ্যে দিয়ে ঈশ্বর তাকে পরিশুদ্ধ করছেন। জীবনের শেষ দিনগুলোতে নিদারুণ কষ্ট ও শোকের মধ্যে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেলেও তিনি নির্বাক অবস্থায় ক্রমাগত লিখে চলছিলেন নানান নীতি কাব্যগাথা আর ভক্তিমূলক সঙ্গীত।
এ সময় তিনি রবীন্দ্রনাথকে একবার দেখতে চান। হাসপাতালের বাজে পরিবেশে রবীন্দ্রনাথের ছিল চরম অস্বস্তি। তা সত্ত্বেও রজনীকান্তের অনুরোধ জানতে পেরে তাঁকে দেখতে হাসপাতালে যান রবীন্দ্রনাথ। সেখানে রবীন্দ্রনাথ নিজে হারমোনিয়াম বাজান আর গান ধরেন রজনীকান্তের সন্তান ক্ষিতীন্দ্র ও শান্তিবালা। রবীন্দ্রনাথের বিদায়ের পর এই অনুভূতির প্রেক্ষিতেই তিনি রচনা করেন-
‘আমায় সকল রকমে কাঙ্গাল করেছে, গর্ব করিতে চুর,
তাই যশ ও অর্থ, মান ও স্বাস্থ্য, সকলি করেছে দূর।
ঐগুলো সব মায়াময় রূপে, ফেলেছিল মোরে অহমিকা-কূপে,
তাই সব বাধা সরায়ে দয়াল করেছে দীন আতুর।’
সাহিত্য সাধনা এবং আরাধনামূলক অসাধারণ সঙ্গীত সৃষ্টিকারী কবি রজনীকান্ত সেন মাত্র ৪৫ বছর বয়সে কলকাতা মেডিকেল কলেজের কটেজ ওয়ার্ডে ১৯১০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। ক্যান্সারের মতো দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েও ঈশ্বরের প্রতি নিজেকে সমর্পণ করে দিয়ে যেসব অশ্রুতপূর্ব গান রচনা, সেগুলোই ছিল তাঁর শেষ দিনগুলোর অনিঃশেষ প্রাণশক্তির উৎস।
তাঁর গান, কাব্য, নীতিকবিতাগুলো পাঠে আজও প্রতিটি বাঙালি নতুন প্রাণশক্তিতে বলীয়ান হয়ে ওঠে।
বিএসডি/এমএম